অংশুর বাড়িতে আজ রিসেপশনের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসেছি। হ্যাঁ শুধুমাত্র নেমন্তন্ন রক্ষা করতেই আসা। একটুও মন নেই। বন্ধুর খুশীর কথা ভেবেই আসা। সাহেব টা কিছুতেই আসতে চাইলো না। ভীষন জেদ ওর। আসলে আমি, সাহেব আর অংশু কলেজ থেকেই খুব ভালো বন্ধু। আমার আর সাহেবের সম্পর্কটা অংশুর জন্যই গড়ে উঠেছিল। অংশু যদি সাহেবকে আমার ভালো লাগার কথা টা না জানাতো, আমি নিজে থেকে কোনদিন সাহেবকে বলতেই পারতাম না। সাহেবের মত একগুঁয়ে, জেদি, বদমেজাজী একটা ছেলে কে আমার কেন ভালো লেগেছিল আমি জানি না। ওর এইরকম স্বভাবের জন্যই ওকে নিজের মনের কথাটা নিজের মুখে কোনোদিন হয়তো বলতেই পারতাম না। সাহেব তো খুব স্পষ্ট করে কথা বলে। ভয় পেতাম এই ভেবে যে ভালোলাগার কথা বললে হয়তো বন্ধুত্বটাই শেষ করে দেবে। অংশুকে যদিও আমি কিছু বলিনি কিন্তু জানিনা কিভাবে ও সবটা বুঝে ফেলেছিল। খুবই শান্ত, ধীরস্থীর, লাজুক স্বভাবের ছেলে অংশু। সাহেবের একদম বিপরীত। মিল ওদের দুটো বিষয়ে, এক হল বই পড়া আর দ্বিতীয় হল মানুষের বিপদে পাশে থাকা। এই জায়গায় মিল থাকার কারনেই হয়ত দুজন এত ভালো বন্ধু। অংশু বোধহয় সাহেবের মনটাও বুঝেছিল। তাই সাহস করে আমার কথা ওকে বলে। আর তারপর থেকেই আমার আর সাহেবের একসাথে পথচলা শুরু।সামনের মাসে আমাদের ও বিয়ে। অংশু ভেবেছিল আমাদের বিয়ের সব কাজ ও একাই সামলে দেবে। কিন্তু ওর বিয়ে টাই যে হঠাৎ করে ঠিক হয়ে যাবে কেউ বুঝিনি। আসলে মেয়ের বাড়ি থেকেই খুব তাড়াহুড়ো করলো। বিয়েতে যেতে পারিনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম আজ সাহেবের সাথেই আসবো। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। ওর সেই একই কথা, যেটা অন্যায় সেটা সবার জন্যই অন্যায়। অনেক যুক্তি তর্কের পরে শেষ পর্যন্ত আমিই হার মেনে নিয়েছিলাম। আসলে ওর যুক্তিগুলোর কাছে আমার কোনও তর্কই ধোপে টিকলো না। ।
বোকার মত এক কোণে একা দাঁড়িয়ে আছি। চেনা তেমন কেউ নেই। অংশু, ওর বাড়ির লোকজন আসছে বটে মাঝেমাঝে কথা বলতে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ। আর ভালো লাগছে না। অংশুর ফ্রেন্ড সার্কেল টা খুবই ছোটো। কলেজের বন্ধু বলতে আজ এখানে আমি একাই। সাহেব টা যে কেন এলো না কে জানে। সবটাতেই ওর খুব বাড়াবাড়ি। একটা সামান্য ঘটনাকে ও এত বড় করে যুক্তি সাজিয়ে আমাকে দেখালো যে আমার আর কিছু বলার ছিল না। সমস্যা টা কয়েকমাস আগের। অংশুর জন্য মেয়ে দেখা চলছে। বি.টেক ইঞ্জিনিয়ার এম.বিএ পাস ছেলের জন্য কাকু কাকিমার দাবী ছিল একটি সুশ্রী ঘরোয়া কণ্যা। জাত, কূল, বংশ কিংবা মেয়ের বাড়ির আর্থিক অবস্থা বিষয়েও ওনাদের কোনো চাহিদা ছিল না। জোর কদমে চলছিল আমাদের নরম স্বভাবের মিষ্টভাষী বন্ধুর জন্য ঘরোয়া কণ্যার সন্ধান। এমন সময় হঠাৎ একদিন সাহেব আমায় ফোন করে জানালো আমাদের অংশুমান চৌধুরী প্রেমে পড়েছে। বেশ অবাক হলাম। কলেজে পড়তে অনেক মেয়েই ওকে আর সাহেব কে পছন্দ করতো। সাহেব সকলের সাথেই কথা বলত। কিন্তু অংশু মেয়েদের থেকে খালি পালিয়ে বেড়াতো। জিজ্ঞেস করলেই বলতো, কোনো মেয়ে ওর সাথে কথা বলতে এলে ওর সব কথা কেমন গুলিয়ে যায়। নিজেকে হাসির পাত্র প্রমাণ করতে চায় না বলেই ও মেয়েদের কে নাকি এড়িয়ে চলে। আমি তো ওর সাথে কলেজের প্রথম দিন প্রায় জোরজবরদস্তি বন্ধুত্ব করেছিলাম। সেই ছেলে কিনা এখন প্রেমে পড়লো! কন্যাটি কে জিজ্ঞেস করতে সাহেব বলল, অংশু দের পাড়ায় যে নতুন বিল্ডিং টা উঠেছে সেখানেই ওরা একটা ফ্ল্যাটে এসেছে। অংশু নাকি সব খবর জোগাড় করে নিয়েছে। আগে ওরা বর্ধমানে থাকতো। ওখানে মেয়ের বাবা একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন সাউথ কলকাতায় চলে এসেছেন অংশু দের পাড়ায়। মেয়ে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশে এম.এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। নাম মেধা। বেশ সুন্দরী। কিন্তু অংশুর মত নাকি লাজুক প্রকৃতির নয়। বেশ কলবলিয়ে কথা বলে মেয়ে। খুব স্মার্ট। এসব শুনে ভাবলাম যে এমন মেয়েকে আমার ঐরকম বন্ধুর ভালো লেগে গেল কি করে। ওতো এত স্মার্ট মেয়েদের এড়িয়েই চলত। সাহেব বলল, আসলে মেয়ে নাকি বেশ রূপসী। গায়ের রঙ চাপা আর একটা মাদকতা আছে। গায়ের রঙ চাপা শুনে খানিক আঁতকে উঠলাম। কারণ অংশুর মা খালি আমায় বলেন, স্বর্ণালী আমার বাবাইয়ের জন্য কিন্তু তোরা ফর্সা মেয়ে খুঁজে দিস। আসলে ছেলের গায়ের রঙ তো দুধেআলতা। তাই তার মায়ের ওমন দাবী। মুখ ফসকে সাহেবকে বলে ফেললাম যে, কাকীমা তো মানবে না রে। এসব কথা শুনলে সাহেব খুব রেগে যায় আমি জানি। এবারেও অন্যথা হল না। ক্ষেপে গিয়ে আমায় চারটি কথা শুনিয়ে দিয়ে বলল, না মানলে নাকি ও ভয়ঙ্কর অশান্তি শুরু করে দেবে। আমি চুপ করে গেলাম। সাহেব তারপর শান্ত ভাবে বলল, দেখ কথা এগিয়ে গেছে অনেক দূর ওদের; কাল কাকু আর অংশুর মামা যাবেন মেধার বাড়ি কথা বলতে। ফোনে কথা হয়ে গেছে। শুনে একটু অভিমান হল অংশুর উপর। এত কিছু ঘটে গেলো ও আমায় কিছুই বলল না! সাহেব আমার অভিমানটা ধরতে পেরে বলল, দেখ তোকে এগুলো বলাও বারণ ছিল; কারণ অংশু তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি আর এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখতে পারলাম না। ……….. সেদিন ফোনে আমি আর সাহেব এটা নিয়েই আলোচনা করে গেলাম প্রায় রাত দুটো অবধি। আর যেন কোন কথা নেই আমাদের। সাহেবের কাছে শুনলাম মেধা নাকি ভীষণ স্বচ্ছ চিন্তাধারার মেয়ে। স্যোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো সমাজের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে। অংশুর পাড়ায় নাকি একটা লোক পন নিয়ে বিয়ে করতে গেছিলো, মেধা নাকি থানায় জানিয়ে দেয়। সে নিয়ে ভয়ঙ্কর হাঙ্গামা পাড়ায়। লোকটা নাকি মেধাকে থ্রেট করে যে সে তাকে দেখে নেবে। আর মেধা? ও তো নিজেই এগিয়ে এসে বলে যে ওই কমপ্লেন করেছে থানায়, আর এর জন্য ওর কোনো ভয় বা আফসোস কিছু নেই। ঐ সময়ে নাকি অংশু সেখানে উপস্থিত ছিল। তো বাছাধনের মনে হয় এসব দেখেই মেধাকে ভালো লেগে যায়। সাহেবের কাছে মেধার সম্পর্কে এসব কথা শুনে মেধাকে দেখার ইচ্ছা টা আরও বেড়ে গেল। ফোনটা রেখে ঐ রাতেই মেধার স্যোশাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট টা ভালো করে ঘেটে দেখলাম। সত্যি মেয়ের মধ্যে স্পার্ক আছে বটে। ভীষণ রকম বিদ্রোহী লেখা ওর গোটা পেজ জুড়ে। সে যাই হোক অংশু ভালো থাকলেই হলো।
পরদিন বিকাল অবধি অপেক্ষা করলাম সাহেবের ফোনের জন্য। মেধার বাড়িতে কি হল, কিছুই তো জানতে পারছি না। সকালে সাহেব ফোন করে বলেছিল কাকু নাকি ওকেও যেতে বলেছেন, কাকিমাও যাচ্ছেন। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল সাহেবের ফোন এলো না। আমি তিনবার ফোন করলাম ও ফোন তুললো না। কেমন একটা চিন্তা শুরু হয়ে গেল আমার। কি হল রে বাবা! হঠাৎ রাত নটা নাগাদ অংশুর ফোন এল। ফোন রিসিভ করতেই হাসি হাসি গলায় অংশু বিয়ের পাকা কথার সংবাদ টা আমায় দিল। আমি ওকে ফরমালি কংগ্রাচুলেট করলাম। আসলে আমার মন তো পড়ে আছে সাহেব কেন ফোন ধরছে না সেদিকে। দশটার দিকে সাহেবের বাবার ফোনে ফোন করলাম। কাকু বললেন সাহেব বলেছে যদি আমি ফোন করি তাহলে বলে দিতে যে ও আজ খুব টায়ার্ড , কাল দেখা করে নেবে। সাহেব এরকম তখনই করে যখন ও খুব বিরক্ত থাকে। তখন ও আমার সাথে কথা বলাটা এড়িয়ে যায়। কারণ ও আমার উপর চেঁচামেচি করতে চায় না। কিন্তু আজ বিরক্তির কারণটা কি বুঝতেই পারছিলাম না।
পরদিন সকালে ও নিজেই ফোন করে বলল অফিসের পর দেখা করতে। বিকেলে একটা কফি শপে দেখা করলাম দুজনে। কালকের বিষয়ে কিছুই বলছে না ও। আমি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম-
“ওই কিরে কাল কি হল একটু গল্প বল!”
“কেন অংশু ফোন করেনি তোকে? ওতো ওখান থেকে বেড়িয়েই বলল তোকে ফোন করবে বিকালে।”
“হ্যাঁ করেছিল তো। সব বলল। খুব হ্যাপি মনে হল জানিস।”
“হম। তাহলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“এভাবে কথা বলছিস কেন সাহেব আমার সাথে, কি হল তোর?”
“কি হবে! যাব্বাবা!”
“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস নাকি, অংশুর বিয়ে টা নিয়ে হ্যাপি নস?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাপি নই আমি। এতটুকু হ্যাপি নই।”
“একিরে এভাবে চিৎকার করছিস কেন, সবাই দেখছে।”
“স্বর্ণালী … মেধা একটা অসভ্য মেয়ে। অংশুর জীবনটা ও শেষ করে দেবে স্বর্ণালী! তুই জানিস ও ঘরে ঢুকে টুক করে সোফায় বসে পড়লো। কাকু কাকিমাকে হাত জোর করে নমস্কার করলো, তাও ওর বাবা বলার পর। আমি ওর পাশের সিটেই বসেছিলাম। আস্তে করে ওকে বললাম কাকু কাকিমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। উত্তরে আমায় বলল ও নাকি মানুষকে আগে চেনে জানে তারপর সম্মানের যোগ্য মনে হলে তবে প্রনাম করে! আর অংশু ওর বাড়ির সব বড়দের প্রণাম করল!”
“দেখ এটা ওর চিন্তা ধারা। এটা বিচার করার বিষয় নয়। মানুষটা ভালো হলেই হল।”
“ওহ্ তাই নাকি! তা এতটাই ভালো চিন্তা ধারা যে কাকিমা যখন জানতে চাইলো ও রান্না জানে কিনা তখন কাকিমাকে মুখের উপর বলে দিল ওর মা ওকে কোনদিন রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়নি ও নাকি শুধু পড়াশোনা নিয়েই থেকেছে। কাকিমা এত ভালো মানুষ জানিস এসব শুনে বলল, চিন্তা নেই আমি বাবাইকে সব শিখিয়েছি। এমনিতে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। এটা শোনার পরেও অসভ্যের মত উত্তর দিল, তাহলে তো ওদিকটা আমাকে দেখতেই হবে না কি বলুন। এমনভাবে কথা বলছে আর এমন হাবভাব দেখাচ্ছে যেন ওর বিয়ের কথা বলতে আসা হয়নি, ওর সামনে ওর শত্রুপক্ষ বসে আছে।”
“এভাবে কেন ভাবছিস তুই? মেয়ে টা তো আফটার অল ভালো সাহেব। তুই তো বলছিলি পাড়ায় কাকে পন নিতে গিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে।”
“সেই খুব ভালো মেয়ে। এতটাই ভালো মেয়ে যে পন নিয়ে বিয়ে করার অন্যায়টা বোঝে কিন্তু পাত্রের কাছে পে স্লিপ চাওয়ার অপরাধ টা বোঝে না।”
“কে চেয়েছে পে-স্লিপ মেধার বাবা? দেখ সাহেব বাবা হয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাববেন না?”
“আর কাকিমা তাহলে রান্নার কথা জিজ্ঞেস করে কি ভুল করেছিলেন? উনিওতো ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই প্রশ্ন করেছেন। আসলে কি জানিস তো মেয়েদের সব কিছু সাচ্চা আর ছেলেদের বেলায় সব অপরাধ তাদের।”
“আরে বাবা ছেলে কি করে, কোথায় কাজ করে এসব জানবে না ওরা?”
“দেখ এসব জানার খবর নেওয়ার অন্য রাস্তা আছে। পে-স্লিপ চাওয়া টা একটা অসভ্যতামি। আর শোন তুই একাই অ্যাটেন করবি বিয়ে টা। আমি যাবো না।”
“মানে টা কি? তুই অংশুর বিয়েতে যাবি না?”
“না”
“এসব কি ছেলেমানুষি করছিস সাহেব?”
“দেখ ভাই, রান্না জানো কিনা এটা জিজ্ঞেস করাটা একটা সিরিয়াস অন্যায়। কিন্তু পে-স্লিপ চাওয়া টা উচিত কাজ। এসব তুই মনে করিস তো? বেশ তো তুই যা না। আমি যাবো না। আর হ্যাঁ এটা ও মনে রাখিস এই মেয়ে অংশু কে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।”
ভরা অনুষ্ঠান বাড়িতেও সাহেবের চিৎকার করে বলা শেষের কথা গুলো মনে পড়ে গিয়ে কেমন কেঁপে উঠলাম। অংশু আর মেধা এখন হিন্দি গানের তালে নাচছে। খুব ভালো লাগছে দুজনকে একসাথে। ভগবান ওদের সুখী করুক। সাহেবের সব কটা কথা যেন মিথ্যে হয়। ভালো থাকুক ওরা।
লেখিকা – সায়নী দাশগুপ্ত