চাকা ব্যাগের দুঃখ
ঝাড়গ্রাম থেকে পুরোপুরি নিজের পাততাড়ি গুটিয়ে আনা খুব একটা সহজ ছিল না। দেড় বছরের বাস। কত খুটিনাটি জিনিস হাওড়া থেকে নিয়ে ওখানে গিয়ে জড়ো করেছিলাম। টিচার্স কোয়ার্টার্স থেকে ঐ সব জিনিস পুনরায় হাওড়ায় নিজের বাড়িতে বয়ে আনতে আমার সম্পূর্ন এক মাস সময় লেগেছিলো। তাও শেষের দিনে দুটো ট্রলি, একটা পিঠ্ ব্যাগ আর একটা ভর্তি ঝোলা ব্যাগ সাথে ছিল। ভেবেছিলাম ট্রেন থেকে নেমে বাস্টান্ড পর্যন্ত একাই টেনে নিতে পারব। তাছাড়া দাদা আসবে নিতে, অসুবিধা হবে না।
ট্রেন থেকে নামতেই দাদার ফোন এল, বলল তার আসতে খানিক দেরি হবে। ভাবলাম এগিয়ে যাই। কিন্তু এগোতে গিয়ে বুঝলাম এ ভাড় আমার একার দ্বারা বহন করা সম্ভব নয়। সামনে একজন কুলি ডাকলাম। সে যা টাকা দাবি করল তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। শুধু অনুরোধ করলাম একটু আস্তে চলুন ভাই, আপনাদের মত জোরে হাটার শক্তি আমার নেই। সে একগাল হেসে বলল – আচ্ছা।
স্টেশন থেকে বেড়িয়ে ওনাকে আবার অনুরোধ করলাম – একটু থেমে যাবেন ভাই, আমার দাদা আসুক, চলে আসবে কয়েক মিনিটে। সে একগাল হেসে বলল – আচ্ছা। বললাম – আপনার খুব অসুবিধা করিয়ে দিলাম বলুন, সে একগাল হেসে বলল – অসুবিধা ঐ চাকা ব্যাগটা করেছে।
মানে?
মানে আর কি আজকাল সবাইকেই দেখি ঐ চাকা ব্যাগ নিয়ে সফর করেন। এতে আপনাদের সুবিধা বেড়েছে আর আমাদের অসুবিধা বেড়েছে। আমাদের দরকার ফুরিয়েছে। এখন আর তেমন প্যাসেন্জার পাই না। কেউ ডাকে না। প্রয়োজনই বোধ করেনা। ঐ চাকা ব্যাগটার জন্যই তো। কথাগুলো বলতে বলতে ওনার চোখ ছলছল করে উঠলো। হয়ত এমনি। আমি বোধহয় বেশি ভাবছি…..
ঐ তো দাদা এসে গেছে, আপনি এবার আসুন। অনেক ধন্যবাদ। আমার ভারি ব্যাগ গুলো গাড়িতে তুলে দিয়ে উনি দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে হাওড়া স্টেশনের যাত্রিদের ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। ওনার মুখটা পরদিনই ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওনার অসুবিধার ওজন টা বড্ড ভারি ছিলো …. দেখুন আজ ও কেমন মনে রেখে দিয়েছি। ভুলতেই পারিনি।
আমি সৎ লোক
ঝাড়গ্রামে তখন টিচার্স কোয়াটার্সে থেকে কসজ করি। বাড়িতে মায়ের নিজের হাতের তৈরি খাবারগুলোকে খুবই মনে পড়ে। মাসে দুইদিনের জন্য হাওড়ায় নিজের বাড়ি গিয়ে সেই পাত পেঠে বসে মায়ের হাতের তৈরি রান্না খাওয়ার মজাটা ঠিক লাভ করা যায় না। আমার মা টকদই খুব ভালো পাতেন। একদিন মায়ের কাছে ফোনে টক দইয়ের গল্প শুনে টক দই খাওয়ার মন হল, সহকর্মীদের বললাম একটা ভালো দুধওয়ালার সন্ধান দিতে, মায়ের থেকে বাড়ি গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসে নিজেই দই পাতবো। তো সে এসেছিলেন এক গোয়ালা। বিশেষত্ব বিশেষ কিছু ছিল না তার, তবু তাকে মনে আছে মনে থাকবে। কেন জানেন? আসুন আজ সে গল্পই করি। …. ১৯.১১.২০১৭ র বিকেল, এক রুগ্ন প্রায় বুড়ো মানুষ এলেন হাতে দুধের ক্যান…. অসিতবরণ কিনা তাই মুখ খানি বোঝা গেলনা বিশেষ.. শুধু চোখ খানি চকচক করছে আর অই সামান্য কয়েকপাটি হলুদ দন্ত। বললাম “দাদু ভালো লাগ্লে নেব কিন্তু.. বললেন “ম্যাদাম, আমি সৎ লোক, পাশের ITI তে কাজ করি ”
২০.১১.২০১৭– দাদু ভালো ছিল গরুর দুধ .. “ম্যাদাম আমি সৎ লোক, পাশের ITI তে কাজ করি”
২১.১১.২০১৭
দাদু আপনার ফোন নম্বর পেলে…. “ম্যাদাম আমি সৎ লোক, পাশের ITI তে কাজ করি ফোন তো নাই”
২২.১১.২০১৭
দাদু কাল থাকবো না…. “ম্যাদাম আমি সৎ লোক, দিলেই তবে দাম নেব, পাশের ITI তে কাজ করি.. ”
২৪.১১.২০১৭
দাদু কাল আসেননি তো? ” ম্যাদাম আমি সৎ লোক, বারন করলে কেন আসবো, পাশের ITI তে কাজ করি”
২৫.১১.২০১৭
দাদু …. “ম্যাদাম আমি সৎ লোক, পাশের ITI তে কাজ করি, বলুন….. ” নাহ থাক কিছু না!!
এরপর থেকে তিনি আসতেন আর দুধের ক্যানটা দিয়ে চলে যেতেন। আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে ক্যানটি নিয়ে ভিতরে ঢুকে যেতাম।
কানওয়ার যাত্রা এবং তার পুরাণ যোগসূত্র
(মহাদেবের জল অভিষেক)
প্রতিবছর শ্রাবণ কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ থেকে শুরু হয় মহাদেবের ভক্তদের কানওয়ার যাত্রা। কাঁধে বাঁক নিয়ে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে বহু পথ পেরিয়ে তারা চলেন মহাদেবের ‘জল অভিষেক’ করতে।
এই কানওয়ার যাত্রার দুইটি পুরাণ যোগসূত্র বা গল্প আছে।
প্রথমটি হলো ত্রেতাযুগের বালক শ্রবণ/শ্রাবণ কুমারের গল্প। শ্রাবণ কুমারের পিতামাতা ছিলেন অন্ধ। পিতামাতা তীর্থ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে পুত্র শ্রাবণ কুমার তাদের কাঁধে নিয়ে তীর্থ যাত্রা করান। রাস্তায় পিতামাতার পিপাসা মেটানোর জন্য তিনি পিতামাতাকে নামিয়ে রেখে কাছের নদীতে জল আনতে যান। কিন্তু রাজা দশরথের ভ্রম বশতঃ তার তীরে শ্রাবণ কুমার প্রাণ হারান এবং মৃত্যুর পূর্বে তিনি রাজাকে বলেন তার পিতামাতার তৃষ্ণা মিটিয়ে আসতে। রাজা দশরথ সেখানে গিয়ে সব কথা বলেন এবং শ্রাবণ কুমারের পিতামাতা তাঁকে পুত্র বিয়োগ যন্ত্রণার অভিশাপ দেন। এই অভিশাপকে পূরণ করতে ভগবান মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের বনবাস পালন করেন। পুত্র বিয়োগের শোকে রাজা দশরথ প্রাণ ত্যাগ করেন। বলা হয়, এই শ্রাবণ কুমারের পর থেকেই কাঁধে বাঁক নিয়ে কানওয়ার যাত্রা শুরু হয়। যেহেতু কাঁধ থেকে বাঁক নামানোর পরই তাঁর মৃত্যু ঘটে সেই হেতু বর্তমানে কানওয়ারিরাও কাঁধ থেকে বাঁক মাটিতে নামান না। ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাঁকটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেন, কিন্তু মাটিতে নামান না।
দ্বিতীয় কাহিনীটি ভগবান পরশুরামের সাথে যুক্ত। ভগবান পরশুরাম পায়ে হেটে গড়মুক্তেশ্বর থেকে গঙ্গাজল তুলে এনে সেই জল দিয়ে পুরা মহাদেবের মন্দিরের (মিরাট, উত্তরপ্রদেশ) শিবলিঙ্গের ‘জল অভিষেক’ করেন। তারপর থেকে সেই মন্দিরের নাম হয়, পরশুরামেশ্বর মন্দির এবং বাবার নাম হয় ‘পরশুরামেশ্বর’। সময়টি ছিল শ্রাবণ মাস। বলা হয় এরপরই প্রচলন ঘটে কানওয়ার যাত্রার।