রোজ ভোরে একদল চড়ুই ব্যালকনিতে এসে কিচির মিচির আওয়াজে শ্যামলীর ঘুম ভাঙায়। সকাল টা তাতে খুব ভালোই কাটে ওর। পাখিদের খেতে দেয়, গাছ গুলোতে জল দেয়। পাখিগুলো ওকে সঙ্গ দেয়। মনে একটা পরম শান্তি অনুভব করে, মনে হয় কেউ তো সাথে থাকে। ওদের তো থাকতে বলে নি শ্যামলী। তবুও ওরা থেকে যায়। ওরা মনের কথা বোঝে, না বলা ভাষা বোঝে। উপভোগ করে সময়টুকু ও। সবটা জুড়ে শুধু শান্তি আর পরম প্রাপ্তি। কিভাবে কিছুটা সময় আনন্দে কেটে যায় মন চায় আরো পেতে।
জীবনের সমস্ত জটিলতা থেকে কিছুটা সময় রেহাই পায় ও। এইতো পরম পাওয়া।
এইদিকে সব কিছু সামলে কিছুটা ভালো লাগা গায়ে মনে মেখে নিয়ে দিন শুরু করে সে। কিন্তু আজকের সকাল টা কেমন আলাদা ছিল।সারাদিন ধরে আজ আকাশ টা গুমোট সাথে চারপাশটা ও।সবটা আস্তে আস্তে কেমন বিবর্ণ লাগতে শুরু করেছে মেয়েটার কাছে। কোথায় যেন হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। ওই যে একটা মাত্র অহংকার ছিল ওর, সেটাও যে একটা মাকাল ফল তা আর বুঝতে বাকি ছিল না শ্যামলীর।বাড়ির লোক গুলো ওকে দেখে আজকাল অবাক হয়ে যায়।কেমন বদলে যাচ্ছে মেয়েটা, সবসময় কেমন খিটখিটে মেজাজ নিয়ে থাকে। কি বা করবে ও, কাকে বলবে এসব।
বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেই শ্যামলী ভালোই বুঝে গিয়েছিলো যে, বিয়ে করাটা অনির্বান এর কাছে কেবল দায়বদ্ধতা ছিল। ভালোবাসা আর দায়িত্ব পালন দুটো এক জিনিস নয়। কিন্তু অনির্বান সেই সত্যটাকে সব সময় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। শ্যামলী দিনভর শুধু একটু ভালোবাসার, নানা ভুল বলা হলো, ভালোথাকার রসদ খুজতো, কিন্তু কোথায় সেই রসদ ?! একটা ঘোরের মধ্যে জীবন চলতে লাগলো, একটার পর একটা প্রশ্ন দানা বাঁধতে থাকে মেয়েটির মনে। তাহলে কি…? তাহলে কি সবই ভুল, সবই শুধু দায়বদ্ধতা?। সব ঝাপসা হয়ে আসে চোখের সামনে , আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে আবার হারিয়ে যায় কোন স্বপ্নের জগৎ এ।
সারাদিন সংসার সামলে, চাকরি সামলে কিভাবে সময় চলে যায় শ্যামলী নিজেই বুঝতে পারে না। রাতের বেলা ক্লান্ত হয়ে যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়, তখন রঙিন দিনগুলোর কথা ভাবে, পেরিয়ে আসা দিনগুলো।
অনির্বান কে সে অন্য ভাবে চিনতো, যখন খুব একা অনুভব করে, পুরোনো ফোনে অনির্বান এর পাঠানো পুরোনো মেসেজ গুলোতে চোখ বোলায়। খুব যত্নে ওই কটা লেখাকে সামলে রেখেছে। আসলে ঐগুলো পড়েই একটু ভালো থাকার চেষ্টা করে।ওর মনে হয় ও যেন পুরনো অনির্বান কে খুব কাছে থেকে অনুভব করে। মন জুড়ে একরাশ ভালোলাগা বয়ে যায়।
সেই পুরোনো দিন , প্রথম পরিচয় সব এক এক করে চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। তেমন ই একটা দুপুরের ছবি , শ্যামলী রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে অনেক্ষন। অনির্বান এর পাত্তা নেই। ওদের আজ সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। এই ব্যাপার টা সবচেয়ে অপছন্দের শ্যামলীর। ওর একেবারেই ভালো লাগে না ওভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে। কত মানুষ যায় পাস দিয়ে আর কত নজরেই না দেখে, কত কথাই না মাথায় ঘোরে তাদের।এমন প্রায় সময় ই ঘটেছে। আস্তে আস্তে ওর অসহ্য লাগছে, একবার ভাবছে বাড়ি ফিরে যাবে। অনির্বাণের বরাবরের অভ্যাস এভাবে মেয়েটাকে অপেক্ষা করানোর।
যাইহোক, খানিকক্ষণ বাদে দুম করে সামনে একটা বাইক থামলো। চোখ তুলে দেখতেই অনির্বান দেরি হওয়ার জন্যে আক্ষেপ জানালো। যদিও এটা তার অভ্যেস। দেরি করেছে তাই ক্ষমা চাওয়া ছাড়া উপায় কি। ক্ষমা চাইলো।
ওদের সম্পর্কের শুরুর সময় এর কথা এটা। পরবর্তী তে আর ক্ষমা চাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল অনির্বাণ।
কোনো মতে মনের জ্বালা কে সংবরণ করে শ্যামলী । গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দেখলো সিনেমার নেক্সট শো ঘন্টা খানেক পরে। সময় কাটাতে তারা পাশেই এক মনোরম জায়গায় চলে গেল, খোলা আকাশের নিচে। ওই সময় দুজনে একা, নতুন করে একে অপরকে চেনা। সব কিছুতেই ভালো লাগা মিশে ছিল। বেশ নির্মল এক সময় কাটছিল দুজনের। একদম স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ। অনির্বাণের হাতের পরশ লাগলো শ্যামলীর হাতে, হঠাৎ মনে হলো যেন এক স্বর্গীয় বিদ্যুৎ ছটা।
হঠাৎ তোলপাড় করে সজোড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো সাথে সাথে শ্যামলীর ও হুশ ফিরেছে। বিদ্যুৎ এর আলোয় সে দেখতে পেলো ওদের দুজনের হাত এক অপরের থেকে অনেক দূরে। বাইরে অঝরে বৃষ্টি ,ভেতরে ঝড় ,ভীষন ঝড়।
লেখিকা: ঝিলিক সাহা