প-চা গুরগুর চা
লাদাখের একটি অতি জনপ্রিয় পানীয় হলো এই গুরগুর চা। এর আরও নাম আছে যেমন প-চা, চা সুমা, চা সুসকান। এই পানীয়টিকে ইংরেজি তে বলা হয় “Butter Tea”। পানীয় টি বানানোর সময় অর্থাৎ গরম দুধের মধ্যে বাকী উপকরণ গুলো ঢালার সাথে সাথে গুরগুর শব্দ তৈরী হয়। সেই কারণেই হয়ত লাদাখ বাসীরা এর নাম দিয়েছেন গুরগুর চা। হিমালয় সংলগ্ন দেশগুলো সবাই গুরগুর চা য়ের ভক্ত। নেপাল, ভুটান, চীন, তীব্বত এবং ভারতের মধ্যে লাদাখ, সিকিম, অরুনাচল প্রদেশে এই মাখন চায়ের প্রচলন আছে।
চা পাতাকে নাকি অর্ধেক দিবস ধরে জলের মধ্যে ফোটানো হয়, বারংবার। চা পাতার রঙ যখন ঘন বাদামী তে পরিনত হয় তখন তার মধ্যে চমরী গাইয়ের দুধের মাখন, দুধ, সামান্য জল, সামান্য খাবার সোডা আর নুন দিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে পানীয়টি প্রস্তুত করা হয়। তবে বর্তমানে পানীয়টির দাম কম করার জন্য এবং যোগান বাড়ানোর জন্য গরুর দুধের ব্যবহার ও শুরু করা হয়েছে। শোনা যায় প্রাচীন ভারতের তাং রাজত্ব, শাক্য রাজত্ব থেকেই এই পানীয়র প্রচলন লাদাখে। গুরগুর চা লাদাখের দৈনন্দিন জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পানীয়। প্রচুর ক্যালোরি যুক্ত মাখন দিয়ে প্রস্তুত করা এই চা পান করলে ওতো তিব্র ঠান্ডা ও শুষ্ক মরসুমে ঠোঁট ফেটে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ও কাজের শক্তি পাওয়া যায়। আসলে যে স্থানের যেমন আবহাওয়া তেমনি তো খাওয়া দাওয়া হওয়া উচিত। লাদাখবাসী সকাল বিকাল গুরগুর চা পান করেন। এই পানীয় দিয়ে তারা অতিথী আপ্যায়ন ও করেন। সেরামিকের বাটিতে গুরগুর চা পরিবেশন করা হয়।
ছন্দ-ছাড়া (ওরা ছন্দ শিখতে আসেনি)
লন্ডনের রয়্যাল মেডেল প্রাপ্ত বিখ্যাত ব্রিটিশ সাইকোলজিস্ট বার্টলেট ক্রিয়েটিভিটির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন – creativity as ‘adventurous thinking’, which he characterised as ‘getting away from the main track, breaking out of the mould, being open to experience, and permitting one thing to lead to another. অর্থাৎ, ক্রিয়েটিভিটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে Originality, Novelty, Uniqueness এই শব্দ গুলো।
একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ এমন কিছু সৃষ্টি করেন যা কেউ আগে কোনদিন দেখেনি। কেউ ভাবতেই পারেনি। তার কাজটি হয় সম্পূর্ণ ভাবে নতুন। এক্কেবারে আলাদা, মৌলিক। মর্ডান সাইকোলজি বলে যে কাজে যে সৃষ্টিতে মৌলিকত্ব আছে তাই হল ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক। এখন সমস্যা হল আমাদের কনজারভেটিভ সমাজকে নিয়ে। একটি মৌলিক কাজ যা সমাজের সকলের কাছে একেবারে নতুন তেমন কাজ বা তেমন সৃষ্টি করতে হলে সেই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে হতে হবে খোলা মনের। কেন খোলা মনের হতে হবে? কারণ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হলে পুরাতন বহু কিছু কে অস্বীকার করতে হবে অথবা সেই পুরাতন কেই হাত ধরে সম্পূর্ণ একটি নতুন রাস্তায় ঘুরিয়ে দিতে হবে। এই অস্বীকার করা এবং পুরাতনের মোড় ঘোরানোর জন্য চাই একটি উন্মুক্ত মন। সঙ্কীর্ণ মন নিয়ে কখনো একটি মৌলিক বস্তু গড়ে উঠতে পারেনি, পারেনা।
শ্রদ্ধেয় কবি জীবনানন্দ দাশ যদি ওই সময় লেখার আগে ভাবতেন, সবাই কবি গুরুর আদলেই এখন লিখেছেন। সুতরাং আমাকেও ওমনি লিখতে হবে। তাহলে তিনি আজ আমাদের মনে “জীবনানন্দ দাশ” হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন না। উনি যেমন ঐসময়ের রাবীন্দ্রিক আদল ভেঙে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে লিখতে শুরু করলেন ঠিক তেমনি কবিগুরুও কোনো পুরাতনকে ভেঙে নতুনের সৃষ্টি করেছিলেন। আর এমন সৃষ্টি করার সাহস, ধৈর্য্য ও উন্মুক্ত মন ক্রিয়েটিভ মানুষদের থাকে। কিন্তু ঐ যে বললাম সমস্যা হল সমাজ। সমাজে এমন কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা পুরাতনের ছত্র ছায়ায় ঘোরা ফেরা করতে পছন্দ করেন। পুরাতনের ছাঁচে ফেলে তারা নিজেরাও অনেক সময় অনেক “ছাঁচে ঢালা” কিছু সৃষ্টি করেন। সমাজে আবার সেই “ছাঁচে ঢালা” সৃষ্টির অনেক ভক্ত ও জুটে যায়। সেটা সমস্যা নয়। সে আমিও ঐ দলেই পড়ি। আমারও এসব ছাঁচে ঢালা লেখার কয়েকজন ভক্ত আছে। তা আছে বেশ ভালো কথা। এরপর ধিরে ধিরে আমার ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকলো। আর আমি মনে করতে লাগলাম আমি বুঝি একজন বড় সৃষ্টিকারে পরিনত হয়েছি। নাহ্ তাতেও সমস্যা নেই। সে আমি মনে করতেই পারি। সমস্যা হয় তখন যখন আমি গর্বে ফুলে উঠে বাকিদের কাজের সমালোচনা করতে শুরু করি। সমালোচনা সুস্থ পর্যায়ে হলে তা অবশ্যই উপকারী। কিন্তু সেই সমালোচনা যদি মনোবিজ্ঞানের নূন্যতম জ্ঞানকে অস্বীকার করে শুরু হয় তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মত এই “ছাঁচে ঢালা” সৃষ্টি কর্তারা সেই সব “ছন্দ-ছাড়া” মানুষ গুলোর চূড়ান্ত সমালোচনা করতে শুরু করি। ঐ “ছন্দ-ছাড়া” মানুষ গুলোকে জোরজবরদস্তি ছন্দ শেখানোর চেষ্টা করি। কেন সেই মানুষটি সমাজের প্রচলিত ছন্দ মেনে কাজ করছে না তা নিয়ে কমিটি গঠন করি, বৈঠক করি, আলোচনা সভা বসাই। নিজেদের অতি জ্ঞানী ও আত্মগর্বে আত্মহারা তিক্ষ্ণ বাক্যে ঐ “ছন্দ-ছাড়া” মানুষ গুলোকে রক্তাক্ত করে তুলি। একবার এটা জানার বা ভাবার চেষ্টাও করিনা যে – ওরা ছন্দ শিখতে আসেনি। বরং প্রচলিত ছন্দ ভাঙতেই ওরা এসেছে। ওরা ক্রিয়েটিভ। আপনার আমার মত “ছাঁচে ঢালা সৃষ্টি কর্তা” নয়। ওরা Divergent Thinkers, আপনার আমার মত Convegent Thinkers নয়। ওদের ক্রিয়েটিভিকে আমরা স্পর্শ ও করতে পারবোনা। ওদের কে ওদের মত ভাবতে দিন। ওদের মত কাজ করতে দিন। সমাজ শুধু খেয়াল রাখুক ঐ Outstanding সৃষ্টি যেন সমাজের অমঙ্গল না ডেকে আনে। ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট। এর বেশি ওদের উপর নজরদারি করলে আপনিই সমাজের পক্ষে অমঙ্গলের হয়ে উঠবেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। “ছাঁচে ঢালা সৃষ্টি কর্তা”গন আত্মগরিমায় এতটাই অন্ধ যে ” ছন্দ-ছাড়া”দের তারা জোট বেঁধে আক্রমণও করবেন এবং রক্তাক্তও করবেন। হয়ত এতেই তাদের সুখ। যুগে যুগে তো এই হয়ে এসেছে। একদল ক্ষমতাশালী “ছাঁচে ঢালা সৃষ্টি কর্তা” একজোট হয়ে একটি নিরীহ “ছন্দ-ছাড়া” মানুষের জীবন ও সৃষ্টি বিপন্ন করে তুলেছে। ইন্টারনেট ঘেটে ক্রিয়েটিভ মানুষ গুলোর জীবনী পড়ুন। দেখবেন প্রত্যেকের সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। এই বুঝি ঈশ্বরের ইচ্ছা। তবে হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও ঐ ছন্দ-ছাড়া মানুষ গুলিকে নিয়েই আজও চর্চা হয়। “ছাঁচে ঢালা সৃষ্টি কর্তা”দের নাম কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
লেখিকা: সায়নী দাশগুপ্ত