সটান লম্বা একখানি কান্ড। অনেক শাখা তার। শাখায় ঐ ছোটবেলায় গল্পে শোনা ডাকাতের মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মতন পাতার ঝাঁড়। গাছের ডগা জুড়ে সবুজ আর সাদায় মেশানো থোকা থোকা ছোট ছোট ফুল। অন্ধকারে রাস্তার ধারে তেনারা এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন যেন মনে হয় ঐ ফুল গুলো ফুল নয় গাছের ডালে বসে থাকা আস্ত এক একটি ভুত। আর অন্ধকারে এমন মনে হবে নাই বা কেন ওতো পাতায় ভরা বলে তো ঐ জায়গা খানাও সর্বক্ষণ শীতল হয়ে থাকে। আর ঐ ফুলের মনমাতানো উগ্র সুবাস! মনে হয় যেন সম্মোহন করছে আর হাতছানি দিয়ে ডাকছে – আয় কাছে আয়!
কি জানি হয়ত আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে লোকেরা এই এনাকে দেখে এইসব কারনেই অন্ধকারে ভয় পেত। তাই এর নাম হয়েছে “ভুত গাছ”। ইংরেজিতে একে Devil Tree নামেই সকলে জানে। ইনি হলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গের State Tree – ছাতিম গাছ। আমাদের গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত ছিল মনে আছে? ছোটবেলায় খুব শুনতাম – “শেওড়া গাছে পত্নী ঠাসা, ছাতিম গাছে ভুতের বাসা “। কিন্তু কেন এই বেচারা Devil Tree বা ভুত গাছ হয়ে গেল তার সঠিক কারণ আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। আপনারা পেলে জানাবেন তো। ছাতিম বেচারার জন্য আমার ভারি খারাপ লাগে। জানেন ওর একটা সুন্দর নাম আছে সংস্কৃত ও হিন্দিতে – “সপ্তপর্ণী”। আসলে একটি ডগায় সাতটি পাতা কিনা তার তাই ওমন নাম। ওত সুন্দর একটা নাম সেটা ছেড়ে কিনা বেচারা কে বিশ্ব জুড়ে ডাকা হয় Devil Tree নামে। কিন্তু বিশ্বাস করুন ও একটুখানি ও শয়তান নয়। বরং ভারি উপকারী গাছ। ওর তো একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে – অ্যালস্টোরিয়া স্কোলারসিস। যেহেতু ওর দেহের কাঠ দিয়ে বাচ্চাদের শ্লেট তৈরী করা হত সেই জন্য “স্কোলারসিস ” নাম হয়েছে ওর। শুধু কি তাই! ওর শরীরের ছাল, ওর গায়ের রস দিয়ে খুব ভালো ওষুধ তৈরি হয়। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও চিকিৎসায় ওর উপকারীতার কথা বলা আছে। এমনকি কবি গুরুর শান্তিনিকেতনের নাম “শান্তিনিকেতন” কেন হয়েছে? সেতো এই বেচারা ছাতিমের জন্যই।
আরে বাবা আপনার মনে নেই সেই ছোটবেলায় শুনেছিলাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা শ্রী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে যখন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছিলেন তখন পথে উনি একটি ছাতিমতলায় বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ঐ ছাতিমের ছাওয়া ওনাকে মানসিক প্রশান্তি দিয়েছিল। পরে উনি ঐ জমিটি জমিদার বাবুর কাছ থেকে কিনে নেন ব্রাহ্ম সমাজের জন্য। আর ঐ জায়গার উনি নাম দেন – শান্তিনিকেতন। তারপর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু সেখানে তার বিখ্যাত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের মানপত্রে নাকি ঐ বেচারার চিন্হ ছাপা থাকে। তবু দেখ বিশ্ব শুদ্ধু মানুষ তাকে Devil বলেই চেনে। তবে ওযে একেবারে নির্দোষ এমনটাও বলব না। ওর বীজ সংগ্রহ করা কিন্তু ভারি মুশকিল। আসলে ওতো খুব লম্বা। আর ওর একদম ডগায় ফল গুলো থাকে। মাটিতে পড়ার আগেই ফল গুলো গাছেই ফেটে যায়। আর বীজগুলো খোলা অবস্থায় গাছেই পড়ে থাকে। ১০০- ১৫০ ফুট উঁচু গাছ থেকে সেই বীজ সংগ্রহ করা খুব দুস্কর ব্যাপার। তারপর আবার তাকে এমন জায়গায় পুঁততে হবে যেন সে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়। নইলে সে বাড়বে না। এছাড়াও ভুতটার অন্য আরো সমস্যা আছে। এই যে ১০০-১৫০ ফুট লম্বা উচ্চতা এই উচ্চতা লাভ করতে কিন্তু তার ৪০-৫০ বছর সময় লাগে। এমনটাই শুনেছি। আর ঐ লম্বা দেহটি কিন্তু খুবই নমনীয়। খানিক ঝড়ের দাপটে ডালপালা সমেত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। বেশিরভাগই রাস্তার ধারে থাকে বলে মানুষের খুব অসুবিধা হয় সে জন্য। ভুত একটা!
কিন্তু আমাদের রাজ্যের State Tree কি শুধু অসুবিধাই দেয় সকলকে। একদমই না। খুবই উপকারী গাছ সে। আর শরতের শেষে যখন গাছে ফুল আসতে থাকে তখন সেই ফুলের মধু মাখানো গন্ধে চারপাশ ভরে ওঠে। এ গন্ধ যদিও উগ্র তবুও মিষ্টি। শুধু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নন; ওর ছাওয়ায় বসে আগের দিনের সাধু সন্যাসীরা জপতপ করতেন। আসলে ও ছাওয়ায় যে বড় শান্তি। কিন্তু বর্তমানে রাজ্যে এ গাছের তেমন কদর নেই। খুব একটা দেখাও যায় না ভুত টাকে। ভুত টাকে বাঁচানোর জন্য ওর উপকারিতা আমাদের প্রচার করতে হবে। নাহলে ভুত টা আমাদের বাঙালির জীবন থেকে একদিন হারিয়েই না যায়।
লেখিকা: সায়নী দাশগুপ্ত