ইউনিভার্সিটি থেকে ছাড়া পেয়ে আমার সোজা বাড়ি ফিরতেই মন করে। তবু যখন তুলিকা দি বলল আজ তার মন টা ভালো নেই কারোর সাথে একটু গল্প করলে তার ভালো লাগবে, তখন না করতে পারলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম -“কোথায় বসবে ন্যাশনাল লাইব্রেরির ক্যাম্পাসে গিয়ে বসবে?”
তুলিকা দি বলল – “ফেরার সময় যদি বাসে উঠতে না পারি!”
আসলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির আলিপুর ক্যাম্পাস থেকে আমরা হেঁটে আসি পি.টি.এস এর সামনে। ওখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকের বাস ধরি। যদি কোনদিন পাঁচ টার বেশি হয়ে যায় তাহলে বাসে সিট পাওয়া তো দূর বাসে ওঠার অবকাশ ও পাওয়া যায় না।
তুলিকা দি বলল – “চল বাস ধরে বাড়ির দিকে যাই, তারপর আভানি মলে গিয়ে বসব।” রাজি হয়ে গেলাম।
তুলিকা দির সাথে এই এমফিল করতে এসেই আলাপ। বয়সে কিছুটা বড় হলেও বন্ধুর মত ই মিশতে পারে সে। আর কথা বলে বুঝতে পারি বিষয় সম্পর্কে অনেক জ্ঞান তার। আমরা আভানি মলে এসে পৌঁছালাম। আভানি মলে গুছিয়ে বসে কথা বলার জায়গা বলতে ওই একদম উপরের ফ্লোরের ফুডকোর্ট। ফুডকোর্টের খাবার গুলোর এত দাম তাই ওখান থেকে কোনদিন কিছু কিনে খাইনা। হ্যাঁ, না খেলেও ওরা বসতে দেয়। আমরা গিয়ে বসলাম। মিনিট দশ পরেই তুলিকা দি খিদে খিদে করতে লাগল। ফুডকোর্ট থেকে খাবার কিনে খাওয়ার জন্য জোর করতে লাগল। আমি পড়লাম মহা বিপদে। আসলে তখন কটা মাত্র টিউশন করি। ওটাই আমার ইউনিভার্সিটি আসার উপায় এবং ওটাই আমার হাত খরচ। প্রতি মাসে চেষ্টা করি টাকা বাঁচানোর। কারণ গবেষণার বই গুলোর অনেক দাম, এছাড়াও সাবজেক্টের বই আছে। সব ওই টাকা থেকেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। চোখ অপারেশনের পর বাবা ধিরে ধিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটা সময়ের পর চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাড়িতে এখন রোজগেরে বলতে একমাত্র দাদা। তাকে আর কত বলব। পুরো সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে। তাই নিজের টিউশন পড়ানোর টাকা দিয়েই টুকটাক দরকার গুলো মিটিয়ে নিই। এখন এই ফুডকোর্টের খাবার কিনে খাওয়া স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে বিলাসিতা। ওদিকে তুলিকা দি একেবারেই নাছোড়বান্দা।
অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে বললাম “দিদি আমার কাছে এখন ওত টাকা নেই খাওয়ার মত।”
দিদি খুব রাগ দেখিয়ে বলল – “তুই কার সাথে এখানে এসেছিস, আমার সাথে। আমার সাথে যখন এসেছিস তখন একদম টাকা নিয়ে চিন্তা করবি না। আমার সাথে আয় কি খাবি ওর্ডার কর।”
তুলিকা দির বাবা শুনেছি মেট্রো রেলের অফিসার। তুলিকা দি নিজেও কলেজে পার্ট টাইম পড়ায়। মন্দির তলায় ওদের মস্ত বাড়ি। এসব কথা তুলিকা দির মুখেই মানায়। তবু কেমন সংকোচ বোধ কাজ করছে আমার মধ্যে। ডোমিনোজের কাউন্টারে গেলাম দুজনে।
তুলিকা দি আমার দিকে মেনুকার্ড টা এগিয়ে দিয়ে বলল – ” দেখ কোন টা খাবি।”
বললাম তুমি দেখ। দিদি জোর করল। অগত্যা একরাশ সংকোচ নিয়ে মেনুকার্ডের সবচেয়ে কমদামী খাবার টাই সীলেক্ট করলাম। অন্যের পয়সায় খেতে হবে সেখানে কোন লজ্জায় দামি খাবার সিলেক্ট করবো! আমার সিলেকশনে ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে তুলিকা দি বলল
” তুই এখনও সেই টাকার কথা ভাবছিস তাই না! সত্যি আশ্চর্য তুই। বললাম না আমার সাথে এলে এরকম টাকা টাকা করবি না। একদম ভালো লাগে না এসব আমার।”
কথা শেষ করে দিদি একটা দামি আইটেম অর্ডার করল। দুটো অর্ডার করছিল। আমি এবার জোর দিয়ে বললাম একটাতেই শেয়ার করে খেয়ে নেবো। দুটো লাগবে না। দিদি ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করল ।খেতে বসে কিছুই খেতে পারলাম না। আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে মেয়েরা সংকোচের উপর উঠতেই পারেনা। তাই দিদি কেই বেশি টা খেতে দিলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়িতে ফিরতে হবে।
“এবার উঠবো দিদি। ”
দিদি উত্তর দিল – “শেয়ার টা দিলি না?”
বললাম “কিসের শেয়ার?”
দিদি বলল “আরে এই খাবার টার”।
বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারলামনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তুলিকা দি বলতে লাগল
“শেয়ার টা যদি আমি না নিই তাহলে তোর খারাপ লাগবে আমি জানি। তাই তোর কথা ভেবেই আমাকে শেয়ার টা নিতে হবে। টাকা পয়সা নিয়ে আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনা।”
আমি স্তম্ভিত। ইচ্ছা করছিল তুলিকা দি কে বলি এসবের মধ্যে তো তুমি আমাকে টেনে আনলে জোর করে। আমি তো খেতে চাইনি। তুমি তো আশ্বাস দিয়ে বললে তোমার সাথে থাকার সময় যেন টাকার কথা চিন্তা না করি। এ কথার অর্থ কী তবে! অপ্রয়োজনীয় খরচের থেকে আমি শত হাত দূরে থাকি সবসময়। কিন্তু সেদিন যে আমার কি হল আমি জানি না। ব্যাগ থেকে পুরো টাকাটাই বের করে দিদির হাতে দিলাম।
“একি পুরোটা দিচ্ছিস কেন! ফিফ্টি ফিফ্টি তো! ”
হেসে বললাম – “তুমি বলছিলে না আজ তোমার মন ভালো নেই। তাই এটা তোমার মন খুশী করার জন্য আমার তরফ থেকে একটা ছোট্ট চেষ্টা। খুশী হয়েছ ? ”
তুলিকা দি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় হাগ করে বলল “ইউ আর সাচ আ ডার্লিং! থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর ট্রিট ডিয়ার। চল বাড়ি যাওয়া যাক।”
সত্যিই তো তুলিকা দি তো একবারের জন্য ও বলে নি যে সেই খাওয়াবে। শুধু আমি যখন বলেছি আমার কাছে এখন এত টাকা নেই তখন সে বলেছে তার সাথে থাকলে টাকা নিয়ে যেন চিন্তা না করি অর্থাৎ অর্ধেক টাকা সে দেবে। এটাই ছিল তার বক্তব্য। কমিউনিকেশন সায়েন্স বলে কমিউনিকেশন স্কিল বৃদ্ধি করার জন্য গুছিয়ে কথা বলার থেকেও মনোযোগ সহকারে কথা শোনা ও কথাগুলোর সঠিক অর্থ অনুধাবন করা বেশি জরুরী। তবে বিত্তবান ও মধ্যবিত্তের একই বাক্যের ভিন্ন অর্থ হতে পারে সেটা সেদিন বুঝেছি। আর সেদিন এটাও বুঝেছি নিজের পকেটে যদি দশ টাকা থাকে তবে ওই দশ টাকাটার উপর নির্ভর করেই সেইমতো আচরণ করা উচিত, কারোর আশ্বাস মূলক বাক্যের উপর নয়।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সুডেন্টদের আসার সময় হয়ে গেছে।বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ চলো…………………।
#”আমি” করে লিখছি মানে যে ওই “আমি”টা আমিই এমনটা বুঝে নেবেন না কেমন।
লেখিকা – সায়নী দাশগুপ্ত