সেই কাঁকভোর থেকে সানাই বাজছে।যতবারই সুরটা কানে আসছে ততবারই শিমুলের বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠছে।ওর কাছে এটা সানাই এর সুর নয় বরং বিদায়ের সুর বলেই মনে হচ্ছে।আজ শিমুলকে সারা জীবনের জন্য ওর বাবা মাকে ছেড়ে দাদাকে ছেড়ে ওর নিজের ঘর ছেড়ে একটা অচেনা অজানা বাড়িতে চলে যেতে হবে।নিজের বিছানায় না শুলে ওরতো ঘুমই আসেনা।কি করে চোখে ঘুম আসবে ওর অন্য বাড়ি গিয়ে?
গত বছর নিজে পছন্দ করে নিজের ঘরের দেয়ালে রঙ করিয়েছে,পর্দা গুলো পাল্টেছে।সেটা কি সব ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য?চোখ বন্ধ হয়ে আসে ওর।কই দাদাকেতো সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছেনা তবে ওকে কেন চলে যেতে হবে?বারবার করে বাবাকে বলেছিলো বিয়ে করবনা।এই বাড়িতে তোমাদের সাথে থাকব।শুনলোনা বাবা।এটাই নাকি নিয়ম।মেয়েদের নাকি বাপের ঘরে থাকা চলেনা।নিজের মেয়ের থেকেও সমাজটা বেশি আপন এদের কাছে।খুব কান্না পায় শিমুলের।কে বানিয়েছে এই আজব নিয়ম।খুব রাগ হয় ওর বাবা মায়ের ওপর।তারা চাইলেই ও এই বাড়িতেই থেকে যেতে পারত।একটা বয়সের পর বাবা মা বুঝি আর ভালবাসেনা মেয়েদের।তাই সাত তাড়াতাড়ি অন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সমাজের অজুহাত দিয়ে।কই সমাজের লোকতো বাড়ি বয়ে কিছু বলতে আসেনা? যা বলে পেছনে বলে।তাতে কি বা এসে যায়?শুধুমাত্র সমাজের ভয়ে নিজের মেয়েকে অন্যের ঘরে পাঠাতে হবে এটার কোন মানে খুঁজে পায়না শিমুল।আজকের পর এই বাড়িটা ওর কাছে পর হয়ে যাবে।বাড়ির লোকজন গুলোও পর হয়ে যাবে।অন্যের অনুমতি নিয়ে ওকে এই বাড়িতে আসতে হবে।যে বাড়িটাতে ওর সবথেকে আনন্দের মুহূর্তগুলো কেটেছে,বাবার স্নেহ মায়ের আদর দাদার সাথে খুনসুটি,সারাটা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে আছে ওর চেনা স্মৃতি।কি করে থাকবে ও এসব ছেড়ে?।আর ভাবতে পারছেনা কিছু ।
ছ মাস আগে শিমুল শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে ওর চেনা স্মৃতিগুলো ছেড়ে,ওর পড়ার টেবিল ওর ডায়েরী ওর রঙ পেন্সিল গুলোকে একা করে দিয়ে চলে গেছে শিমুল।ওরা শিমুলের খুব আপন ছিল ।ওরাও খুব মিস করে শিমুলকে।শিমুলও ভাল নেই ওদের ছেড়ে ।
শিমুল আজ ওর বাড়ি ছেড়ে অনেকটা দুরে।প্রতিটি মূহুর্ত নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশের সাথে ।নিয়ম রক্ষা করতে দ্বিরাগমনে গিয়েছিল বাপের বাড়ি ।এখনতো আর নিজের বাড়ি বলা চলেনা তাই বাপের বাড়ি বলতে হয়।দ্বিরাগমনের পর আর যায়নি ও বাড়ি।অনক অভিমান জমে আছে ওর বুকে তাই বাবা বার বার নিতে আসা স্বত্তেও শিমুল যায়নি।
দিন ক্ষণ দেখে লোক খাইয়ে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন ।তাহলে ও কেন যাবে আবার?আসার সময়ে মা বলে দিয়েছিল স্বামীর বাড়িটাই মেয়েদের নিজের বাড়ি।মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে বলেছে মা।ওতো তাই করছে।তবে ও কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি যাবে ?
বাবা সবসময় বলত শিমুল তুই হাসলে আমার বাড়িটা ঝলমল করে ওঠে।এভাবেই হাসিস সারাজীবন।তবে সেদিন ওর স্বামী যে বলল,এভাবে জোরে জোরে নাকি বস্তির মেয়েরা হাসে।ভদ্র ঘরের মেয়ে বউরা নাকি এভাবে হাসেনা।জোরে জোরে হাসতে নেই।উচ্চস্বরে কথা বলতে নেই ।তবে বাবা কি মিথ্যে বলত?
বরাবরই শিমুল গান ভালবাসে।ওর আগ্রহ দেখে বাবা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল।কারনে অকারনে প্রান খুলে গান ধরত শিমুল।সব কাজ ফেলে বাবা মা ওর গান শুনতে বসে পরত।বাবা বলত তোর গান শুনলে প্রানটা জুড়িয়ে যায়।
অনেকদিন পর সেদিন একখানা গান ধরেছিল শিমুল,শাশুড়ি বলল সব কাজ ফেলে গান গাইতে বসে পরলে যে বড়।গান গাইলে বাড়ির সবার পেট ভরবে তো বউমা।তবে কি বাবা সেদিনও মিথ্যে বলেছিল?খুব রাগ হয় ওর বাবার ওপরে।ছোটবেলা থেকে তো কতকিছু শিখিয়েছে ওকে।শুধু তাদের ছেড়ে বাঁচতে শেখায়নি কেন?কেন সেই ছোটবেলা থেকে পরম যত্নে বড় করেছিল ওকে?কেন ছোটবেলা থেকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়নি যে একদিন হঠাৎ করেই ওকে পর করে দেবে।
একটা ছেলে সারাজীবন নিজের বাড়িতে থাকার অধিকার নিয়ে জন্মায়।নিজের বাবা মায়ের কাছে থাকার অধিকার পায়।তাদের দেখাশুনা করার সুযোগ পায়।সেই একই অধিকার থেকে মেয়েটাকে কেন বঞ্চিত করা হয়।
শিমুলের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই শিমুলদের বাড়িটার ওপরে নজর পড়েছে অনিন্দ্য সরকারের।আদরের মেয়েকে ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ও দান সামগ্রী দিয়েছিল শিমুলের বাবা।যা যা চেয়েছিল অনিন্দ্যর বাড়ির লোক তার চেয়ে বেশি বই কম নয়।
লক্ষ্য একটাই যাতে মেয়েটা ভাল থাকে।বিয়ের পর থেকেই অনিন্দ্যর একটাই আবদার যে করেই হোক শিমুল যেন বাড়িটা লিখিয়ে নেয় বাবার কাছ থেকে।বাবার আদরের মেয়েকে এটুকুতো দিতেই পারে ।প্রথম কিছুদিন আদর করেই আবদার করত।শিমুলকে যখন কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি তখন সেই আদর অত্যাচারে বদলে গিয়েছিল।একরাশ অভিমান ছিল বাবা মায়ের ওপর তাই কোনদিন কোন কথা বাবা মাকে জানায়নি।
সেদিন সকাল থেকে বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা।দরজার বাইরে পুলিশের গাড়ি।মিডিয়ার লোকজনও এসেছে।তাদের চোখ মুখে অজস্র প্রশ্নের ভিড়।হবে নাই বা কেন,বাড়ির একমাত্র বউ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে যে।অথচ কেউ কোন কারন বলতে পারছেনা।
“শিমুল সরকারের মৃত্যু রহস্য”এরকমই হেডলাইন ভেবে রেখেছে কালকের খবরের কাগজের জন্য মিডিয়ার সাংবাদিকরা। পোস্টমর্টাম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত পুলিশ কিছুই জানাতে পারছেনা।বাড়ির উঠোনে সাদা কপড়ে ঢাকা একটা নিথর শরীর।তাকে খুন করা হয়েছে নাকি সে নিজেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন কাটা ছেড়া হবে।জলজ্যান্ত মেয়েটি হঠাৎ করেই সবার প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালো ।কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও কারো কোন মাথাব্যাথা ছিলনা যাকে নিয়ে তাকে ঘিরে আজ অজস্র মানুষের ভিড়।কি অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
শিমুলের বাবা মাও এসেছে মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখতে।পুড়ে যাওয়া মুখটা দেখে আতকে উঠেছিল শিমুলের বাবা।একবার লুচি ভাজতে গিয়ে হাত জ্বলে গিয়েছিল শিমুলের।টানা তিন ঘন্টা কেঁদেছিল শিমুল।শিমুলকে উনুনের কাছে পাঠানোর জন্য মাও সেদিন বকুনি খেয়েছিল বাবার কাছে।ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটা যে আগুনকে বড্ড ভয় পেত সে আজ আগুনের কোলেই নিজেকে সোপে দিয়েছে নাকি তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছে সেটা যদিও প্রমাণ সাপেক্ষ।যদি প্রমাণ হয় শিমুলকে খুন করা হয়েছে তাতেও কি শিমুল ফিরে আসবে?
আজও দূরে কোথাও যেন বিদায়ের সুর বাজছে।
এক ফোঁটা জল নেই আজ শিমুলের বাবার চোখে।শোকে পাথর হয়ে গেছে বোধহয় মানুষটা।বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।বারবার শুধু একটা কথাই কানে বাজছে “বাবা আমি বিয়ে করবনা সারাজীবন তোমাদের সাথে থাকব”।
(হয়ত সবাইকেই শিমুলের মত অকালে চলে যেতে হয়না।হয়ত সবাই অনিন্দ্যদের মত নয়।কিন্তু বিয়ে নামের বেড়াজালে সব শিমুলদেরই জড়াতে হয়।কেন তারা চাইলেও তার চেনা ঘরটাতে থাকতে পারেনা?কেন তাদের চেনা পরিবেশ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হয়?সমাজের এই নিয়ম যেদিন ভেঙে দেওয়া যাবে নারী পুরুষ ঠিক সেদিনই এক আসনে বসতে পারবে।বোধহয় তার আগে নয়।)
গল্পের লেখিকা: মনি রায় ঘোষ