নৌকাবাড়ি সেভেন ডি, ‘বাড়ির ড্রয়িং রুমে, যে ভদ্র মহিলা আমার সামনে অবাক হয়ে বসে আছেন,পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক একটু পরে আমি তাকে খুন করবো। ‘ বিনিময়ে পাবো ২৫ লাখ টাকা । যার অর্ধেকটা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি । ধার দেনা শোধ করে এখনো লাখ পাঁচেক ব্যাংকে জমা রয়েছে । বাকি অর্ধেকটা কাজ শেষ হলে ।
কাজটা শেষ করে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে হবে । সব ঠিক করা আছে । প্রথমে কলকাতা যাবো । যেখান থেকে প্রয়োজন হলে দিল্লি । তা না হলে ফিরে এসে চাকরীতে যোগ দিবো । এ খুনটা করতে পারলে চাকরীটাও পাকা হয়ে যাবে । যদিও কাজটা আমার জন্য তেমন কঠিন কিছু না । তবুও নিরাপত্তার জন্য সব প্লান মাফিক করতে হবে । এটাই শর্ত ।
এর আগেও আমি একটা খুন করেছি । যদিও সেটা টাকার জন্য নয় । কোন প্রকার স্বার্থ ও তাতে জড়িত ছিলো না। কিন্তু তবুও হুট করে তিথির মামাকে খুন করে ফেললাম। ভেবেছিলাম ধরা পরে যাবো । থানা পুলিশ হবে । ফাসিটাসিও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কিছুই হলো না । খুন করার সাত বছর পরেও আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর একটা খুনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি । এই সাত বছরে অপরাধ জগতের অনেক কিছু শিখেছি । অনেকের সাথে সখ্যতা বাড়িয়েছি । যে কোন কাজ প্লান করে করতে শিখেছি।
তিথি আমার স্কুলের ক্লাসমেট । একই শ্রেণীতে পড়তাম । হালকা পাতলা গড়নের তিথির চোখ দুটো ছিলো অসাধারণ স্বচ্ছ । দেখলে মনে হতো ঈশ্বর বঝি অতিরিক্ত সময় নিয়ে বানিয়েছেন । আমি আসলে ওর নয় ওর চোখের প্রেমে পড়েছিলাম । আমাদের খুব একটা কথাবার্তা হতো না । ওয়ান সাইট প্রেম যাকে বলে । প্রতিদিন ক্লাসে গেলে আমি ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম । কখনো কখনো চোখাচোখি হলে লজ্জা পেতাম । ক্লাসে বিবেক ছাড়া আমার আর কোন বন্ধু ছিলো না । কারো সাথে কথাও হতো না । এক কোণে বসে থাকতাম । নোট নিতাম । স্যার,ম্যাডাম যা পড়াতেন তার বেশির ভাগ ই মাথায় ঢুকতো না । বুঝতে পারতাম না । আবার লজ্জায় জিজ্ঞাসাও করতাম । তবুও প্রতিদিন ক্লাসে আসতাম । তিথিকে দেখার জন্যই আসতাম ।
ক্লাস ছাড়া আর একটা জায়গায় আমি নিয়মিত যেতাম সেটা কালীবাড়ি। তবে ভক্তির কারণে নয় । কালীবাড়ি যেতাম রাতের খাবার খেতে । সব দিন অবশ্য খাবার ঝুটতো না । যেদিন খাবার ঝুটতো সেদিন বেশ ভাল বোধ করতাম না ঝুটলে রাগ চেপে যেতো । ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পরতাম । নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগতো । মনে হতো, পৃথিবীটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি । তখন খুনের ইচ্ছে পেয়ে বসতো । মনে হতো কাউকে খুন করে ফেলি । গজগজ করতে করতে হাটতে থাকতাম । মাথা ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ড কিছুতেই থামতাম না। একসময় ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বসে পরতাম ।
মাথা ঠান্ডা হয়ে এলে আবার ভাবতাম , একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে । একদিন আর খাবারের অভাব থাকবে না । অসম্ভব একটা ভাল গুন ছিলো আমার । সেটা হলো , নিজেকে লুকিয়ে রাখান গুন । আমার ভেতরের রাগ, ক্ষোভ বাহির থেকে দেখে কেউ আন্দাজ পারতো না ।
একবার আমি টানা তিনদিন না খেয়ে ছিলাম। প্রথম দিন খুব কষ্ট হয়েছিলো। মনে হচ্ছিল মারা যাবো । প্রচন্ড ক্ষুধায় মাঠের ঘাস খেয়েছিলাম। ২য় দিনের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্যামন একটা ঘোরে মধ্যে চলে যাই । তারপর আর কিছু মনে ছিলো না । মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব অলৌকিক জিনিস দেখতে পেতাম । হয়তো অন্য জগতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছিলাম । এতো আলো , এতো রং । সে এক অন্য ভূ – বন । অন্য জগত ।
সেই তিনদিন কালিবাড়িতেই পরে ছিলাম । হঠাৎ এক সময় দেখলাম, সাদা পোশাক পরা লম্বা, লম্বা কিছু লোক আসলো । তাদের হাতে বড় বড় থালায় সাজানো নানা রকমের খাবার। সে সব খাবার আমার কোনদিন চোখে দেখিনি ।
তাদের মধ্যে নেতা টাইপের একজন আমাকে উঠিয়ে বসিয়ে পরম যত্নে খাওয়াতে শুরু করলো । আমি ও খেতে লাগলাম । এতো সুস্বাদু খাবার আমি জীবনে আর কখনো খাইনি ।
এতো অভাব এতো দারিদ্র্যতার মাঝেও তিথিকে আমার ভাল লাগতো । ওকে দেখলে সব ভুলে যেতাম । ক্ষুধা লাগতো না তৃষ্ণা পেত না । নিজের দরিদ্রতা, অসহায়ত্ব কিছুই মনে থাকতো না । মনে হতো তিথি ছাড়া জগতে কোন কিছুর প্রয়োজন নেই আমার ।
সেই তিথি হুট করে একদিন ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিলো । আমার মনে হচ্ছিলো পাগল হয়ে যাবো । বিবেক বিষয়টা টের পেয়ে খোজ লাগাল।
তারপরই তিথির মামাকে খুন করে ফেললাম । ব্যাপারটা এতো সহজে ঘটে যাবে বুঝতে পারিনি । কারওয়ান বাজার থেকে মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে কেন ছুরিটা মুহূর্তে কাজটা করে দিলো ।
তিথি থাকতো পাল পাড়াতে ওর মামা মামির সাথে । একরাতে রাতে ঘাপটি মেরে ছিলাম ওদের বাসার সামনের গলিটাতে । তিথির মামা রিকসা থেকে নেমে গলিতে ঢুকতেই খুব স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গিয়ে বললাম, মামা ভাল আছেন । লোকটা আমাকে চিনতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালেন । এক হাতে বাজারের ব্যাগ অন্য হাতে কিছু ফাইল পত্র । কিছু বুঝে উঠার আগেই ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলাম পেটে । তারপর কয়েকবার উপর, নিচ ঘুরিয়ে বের করে আনলাম ।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ইলেক্টিসিটি চলে গেলে পুরো গলিটা অন্ধকার হয়ে যায়। মৃত্যুর জন্য যেনো সব আয়োজন করাই ছিলো । মামা বেচারা কোন শব্দই করল না । পেটে চেপে ধরে মা গো বলে শুয়ে পরলেন ।
আমি তার প্যান্টের পেছন পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করে নিয়ে সোজা হাটা দিলাম । এটা অবশ্য আমার প্লানে ছিলো না । কিন্তু তবুও কেন করলাম জানি না ।
গলি থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় চলে গেলাম। সেখান থেকে হাত মুখে ধুয়ে বিবেকের বাড়িতে পুরাণ দীঘিতে । খুনটা করতে পেরে আশ্চর্য রকমের ভাল লাগছিলো । কোন ধরনের অনুশোচনা হচ্ছিল না । উল্টো মনে হচ্ছিলো তিথিদের বাসায় যাই । গিয়ে জিজ্ঞাসা করি , “ও সোনা মেয়ে ক্লাসে আসো না কেন ? কাল থেকে ক্লাসে আসো । তুমি জানো না , তুমি ক্লাসে না আসলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না “।
পরের দিন ক্লাসে গিয়ে জানতে পারলাম , তিতির মামা নাকি খুন হয়েছে । অফিস থেকে ফেরার সময় বাসার কাছেই তিনি ছিনতাইকারীদের কবলে পরেন । ছিনতাইকারীরা মানিব্যাগ,ঘড়ি দিতে বললে মামা অস্বীকার করে ফলে ছিনতাইকারীদের সাথে মামার বাক বিতণ্ডা হয় । বাক বিতণ্ডার এক পর্যায় ছিনতাইকারীরা ছুরি মেরে পালিয়ে যায় ।
খবরটা শুনে সুরেশ ফিসফিস করে বলল, ভাল হয়েছে গাধাটা মরেছে।
আমি কিছু বললাম না । অন্য সবার সাথে তিথিদের বাড়িতে গেলাম । গলিটা দেখলাম । রক্ত পরে আছে সেটাও দেখলাম । গলির শেষ মাথায় দাড়িয়ে একবার পুরো ঘটনাটা কল্পনা করলাম ।
পুলিশ , আত্মীয় স্বজন , অফিসের কলিগ, পাড়া প্রতিবেশি , লোকজনে পুরো বাসা গিজগিজ করছিলো। মৃত বাড়ির কোন প্রাইভেসি থাকে না । যার যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারে । ইচ্ছে হলে , এটা ও নিয়ে ও যেতে পারে । কেউ কিছু বলে না । সবাই কেমন একটা শোক শোক ভাব করে থাকে ।
শোবার ঘরে তিথির সাথে চোখাচোখি হলো । অনেকদিন পর তিথিকে দেখে ভাল লাগলো । মাথার ভেতর সেই , লাইন গুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো , “ও সোনা মেয়ে ক্লাসে আসো না কেন ? কাল থেকে ক্লাসে আসো। তুমি জানো না , তুমি ক্লাসে না আসলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না “।
হালকা লাল সবুজ সালোয়ার কামিজে ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো একটা পদ্ম ফুটে আছে । মামি বার বার জ্ঞান হারাছিলেন । আত্মীয় স্বজন ,পাড়া প্রতিবেশি সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত ।
পোস্টমর্টেমর পর মেডিকেল থেকে লাশ আসলে জানাজা শেষে শশানে নিয়ে যাওয়া হলো ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। স্নান করে ক্ষেতে গিয়ে তিথির মামার টাকায় তাহারী খেলাম । ম্যানি ব্যাগে ১৫ হাজার টাকা ছিলো । এতো টাকা একসাথে আমি আগে কখনো দেখিনি ।
টাকাটা পেয়ে আমার বেশ উপকার হলো । পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হলো না । মাস চারেক আর না খেয়েও থাকতে হয়নি । ক্যান্টিনের বিল পরিশোধ করে এরপর থেকে ক্যান্টিনে খেতে লাগলাম।
তিথি এখন একটা কলেজে ফিজিক্স পড়ায় । শুনেছি বিয়ে থা করেছে । ছেলে মেয়ে নেই । বিবেক একদিন সে কলেজের ফোন নাম্বার যোগার করে দিলো।
আমি মাঝে মাঝে সেই নাম্বারে ফোনে করে তিথিকে চাই । কিছু সময় পর অপর প্রান্তে ও ফোন ধরে হ্যালো, হ্যালো করে । আমি কিছু বলি না । প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন আর রাগ করে না । হয়তো বুঝতে পারে । দু’তিনবার হ্যালো হ্যালো করে তারপর চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি ।
শুনেছি , অপরাধ করতে করতে নাকি মানুষের অপরাধ করার প্রবনতা বেড়ে যায় । অপরাধকে আর অপরাধ বলে মনে হয় না । আমার ও হয়তো তাই হয়েছে ।
একটু পর যে খুনটা করবো । সেটার জন্য একটুও ভাবনা হচ্ছে না । বরং এ খুনটা করার জন্য প্লানটা পুরো একমাস ধরে করা হয়েছে । একেবারে নিখুত প্লান । তাই ধরা পরার কোন চান্স নেই ।
খুনটা এমন ভাবে করতে হবে , যেনো মনে হয় সুইসাইট । রাতে মন্জু সাহেব বাড়িতে ফিরে দেখবেন । তার স্ত্রী মরে পরে আছেন । ডাক্তার ডাকা হবে । সে এসে সাটিফিকেট দেবেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে বার্থটাবের জলে ডুবে মৃত্যু । পুরোনা চাল কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য । তবুও নিরাপত্তার জন্য আমাকে শহর ছাড়তে হবে ।
কাজটা শেষে সোজা চলে যাবো মন্জু সাহেবের অফিসে । সেখান থেকে অফিসের গাড়ি করে বাগডোগরা। আমার পছন্দ ছিলো দার্জিলিং । কিন্তু যেতে হচ্ছে বাগডোগরা । কারণ বাগডোগরাতে মন্জু সাহেবের একটা প্রযেক্ট চলছে । কিছুদিন সেটার দেখ ভাল করবো ।