পাঁচ পেগ ব্লেন্ডার্স প্রাইড খাওয়ার পর মাথায় কিক্ করল সৌভিকের। ঠিক তখনই ট্রেনি এক্সিকিউটিভ সুমনা এসে বলল, ”-স্যর, আপনাকে মিস্টার রাঘবন ডাকছেন।”
এইরকম সময় মাথাটা ধাঁ করে গরম হয়ে যায়। প্রাইভেট কোম্পানিতে মিডল লেভেল ম্যানেজমেন্টে কাজ করা যেন একটা বন্ডেড লেবারের মত। রাঘবন তাদের কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। রাঘবন ডাকা মানেই আবার একটা মেইল লেখা। আজ সারাদিনে প্রায় পনেরোটা মেইল লিখতে হয়েছে তাকে। সে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারের রিজিওনাল হেড। দফায় দফায় মিটিং সেরে তবে সন্ধ্যেবেলার ককটেল পার্টিতে জয়েন করেছে। এখন আর কিচ্ছু ভাললাগছেনা।
“হ্যালো মিষ্টার রাইটার, তোমাকে এক্ষুনি একটা মেইল করতে হবে। তোমার মেইল গুলোর মধ্যে একটা লিটারারি ফ্লেভার থাকে। “সৌভিকের হাতে হুইস্কির গ্লাস দেখে রাঘবন ঠাট্টা করে বললেন, ‘-দশ পেগ ক্রস হয়নি তো?’י
একবার এইরকমই একটা অফিসের ককটেল পার্টিতে প্রায় দশ পেগ হুইস্কি খাওয়ার পর রাঘবনের নির্দেশে সৌভিককে বেশ গুছিয়ে একটা বড়সড় মেইল লিখতে হয়েছিল। তখন বেখাপ্পা ধরনের পা টলছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, জিভ জড়িয়ে গেছে তবু, সমস্ত লেখাটির মধ্যে একটিও বানান ভুল বা গ্র্যামাটিক্যাল মিসটেক হয়নি। মিষ্টার রাঘবনের দৌলতে সৌভিকের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা কোম্পানির সবাই জেনে গেছে, আজও তা নিয়ে আলোচনা হয়।
পার্টি শেষ হতে হতে রাত প্রায় সাড়ে নটা বেজে গেল। সৌভিকের নিজের গাড়ি আছে, সে নিজে ড্রাইভ করে। ড্রিঙ্ক করলেও গাড়ি চালানোর সময় সৌভিকের কখনও হাত কাপে না। সৌভিক বলল, ”-না না, তোমাকে আমি ব্যারাকপুরে ছেড়ে দিচ্ছি।গাড়ি থাকতে কেউ এত রাতে বাসের জন্য ঠান্ডার মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে নাকি?”
এতক্ষন সোমা ও সুমনা গাড়ির পিছনের সিটে বসেছিল এবার, সৌভিকের অনুরোধে সুমনা সামনের সিটে এসে বসল। সুমনা সামনের সিটে এসে বসতেই ওর শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ সৌভিকের মুখে এসে ঝাপটা মারল। কত সামান্য জিনিষ যে মানুষের মনের মধ্যে কী আগুন ধরিয়ে দেয় তা কেউ জানেনা।
নতুন জয়েন করা এই ট্রেনি মেয়েটিকে সৌভিক এতদিন খেয়ালই করেনি, মেয়েটি সোমার ব্যক্তিত্ত্বের তলায় চাপা পড়ে থাকে। এবার সৌভিক মেয়েটিকে ভাল করে দেখল। বাইশ তেইশ বছর বয়স, ছিপছিপে গড়ন, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ আছে। সৌভিক বেরোতে যাবে এমন সময় সোমা বলল, ”- এ্যাই সৌভিক দা, আমরাও তো তোমার ওদিকেই যাব।আমাকে আর সুমনা কে একটু লিফ্ট দেবে?
সোমা সৌভিকের দীর্ঘদিনের কলিগ ও বন্ধু যদিও এই মুহূর্তে সৌভিক হল সোমার বস আর সোমার আন্ডারে ট্রেনি হিসেবে জয়েন করেছে সুমনা বলে নতুন মেয়েটি।
চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের আলো আঁধারি গায়ে মেখে হু হু করে এগিয়ে চলেছে সৌভিকের সাদা রঙের ওয়াগনার। গল্প করতে করতে ওরা সোদপুর পর্যন্ত চলে এল। সোদপুর আসতেই সোমা বলল, ”- এবার আমি নামবাথ্যাঙ্ক ইউ সৌভিক দা, তুমি সুমনা কে ব্যারাকপুরে নামিয়ে দিও প্লিজ।” সৌভিক কে যেতে হবে আরো একটু দুরে, শ্যামনগরে।
সুমনা বলল, ”-আমিও বরং এখানেই নেমে যাই, বাস টাস কিছু একটা পেয়ে যাব।”
“বাড়িতে কে কে আছেন তোমার?”
“বাবা, মা, বোন-‘”
“বাবা কী করেন?”
”বাবা প্যারালাইজড, অনেক দিন ধরে’-
“মা কী চাকরি করেন?”
‘না, সেলাই শেখায়, বোন স্কুলে পড়ছে।এই কারনেই এত তাড়াতাড়ি, আমার তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যাওয়াটা খুব দরকার।”
মেয়েটির গলার স্বর আর কথা বলার স্টাইলটা ভারি সুন্দর। সৌভিকের ভীষন ইচ্ছা করল মেয়েটির হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে নিতে।
খানিকটা সহমর্মিতার ভঙ্গিতেই সে পাশে বসে থাকা মেয়েটির হাতের উপর নিজের হাত রাখল। আচমকা পুরুষ স্পর্শে সুমনা কেঁপে উঠল। একটা ঠান্ডা স্রোত তার পিঠ দিয়ে নেমে গেল। সে আলগোছে হাতটাকে সরিয়ে নিল। সৌভিক এবার বেশ শক্ত করে হাত তার পিঠ দিয়ে নেমে গেল। সে আলগোছে হাতটাকে সরিয়ে নিল। সৌভিক এবার বেশ শক্ত করে হাত চেপে ধরল সুমনার।
“স্যর প্লিজ গাড়িটা একটু থামাবেন, আমি পিছনের সিটে বসবাসামনে বসতে আমার খুব ভয় লাগে।”
“ভয়ের কী আছে?আমি তো আছি।”
সৌভিক সুমনা র কাঁধে হাত রেখে কাছে টানার চেষ্টা করল।সুমনা এক ঝটকায় সৌভিক কে সরিয়ে দিল।
‘স্যর, প্লিজ গাড়িটা থামান, আমি পিছনে বসবাপ্লিইজ’এইবার সৌভিক খানিকটা রেগে গিয়ে ধমকে উঠল-“আঃ! হোয়াই ডু ইউ রেসিষ্ট মি? আই লাইক ইউ, উই জাষ্ট এনজয় দ্য মোমেন্ট, জাস্ট এনজয় দ্য মোমেন্ট।”
“সরি স্যর, আই কান্ট।প্লিজ স্টপ দ্য কার’ সৌভিকের মাথায় এবার আগুন জ্বলে উঠল। মেয়েটা কী বুঝতে পারছেনা এই কোম্পানিতে সৌভিকের কী ক্ষমতা। মেয়েটা কী জানেনা যে সৌভিকের একটা কলমের আঁচড়ে কালকেই মেয়েটার চাকরি চলে যেতে পারে!
“স্যর আপনি যদি গাড়ি না থামান তাহলে কিন্তু..”
সৌভিক একটা অন্ধকার জায়গায় গাড়ি থামাতেই সুমনা নেমে গিয়ে পিছনের সিটে গিয়ে বসল। হাইরোড দিয়ে একশো কিলোমিটার বেগে হুস্ হুস্ করে তখন বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মালবাহী লরি।
মেয়েটা পিছনের সিটে এসে বসতেই সৌভিকের কেমন জেদ চেপে গেল। দ্য বিচ্ শ্যুড বি পানিশড। এত বড় স্পর্ধা! একটা সামান্য ট্রেনি হয়ে একজন রিজিওনাল হেড কে রিফিউজ, কন্টিনিউয়াসলি ইগনোর, এত বড় ইনসাল্ট! সৌভিক একটানে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে ফেলল। ক্ষুধার্ত বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল হরিণটার উপর। হরিণটা তীব্রভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই বাঘটা হরিণটার গলায় মরণ কামড় বসাল, তারপর ছিন্নভিন্ন করে দিল। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, সম্পূর্ণ তৃপ্ত হওয়ার পর রক্তমাখা মুখ নিয়ে বাঘটা চারপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“একী! তোমার ঠোঁট থুতনি গলায় কাটলো কিভাবে? এত রক্তারক্তি হল কিভাবে?”
কাকলি সৌভিককে জড়িয়ে ধরেছে।
“আর বোলোনা, টিটাগড় আর খড়দার মাঝখানে দেখি একটা ছেলে জোর করে একটা মেয়েকে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। মেয়েটা চিৎকার করছে, গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেলাম, খানিকটা ধস্তাধস্তি হল যাইহোক, শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে সেভ করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরেছি।”
“যদি ধরেও নিই যে আপনি রেপ করেননি, যদিও মেডিকেল রিপোর্ট আমাদের হাতে আসেনি এখনও, তবুও ড্রিঙ্ক করে ড্রাইভ করার অপরাধে আপনাকে তো অ্যারেষ্ট করা যেতেই পারে, তাইনা?” পুলিশ অফিসারটির ছুরির ফলার মত চোখের দৃষ্টি সৌভিকের হৃৎপিন্ডকে ফালাফালা করে দিল।
”দেখুন আপনি সো’কল্ড ভদ্দরলোক! বাড়িতে বৌ বাচ্চা আছে। রাতের বেলায় একটা আনটাটকা মেয়েছেলেকে পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি, এই তো বাংলা কথা।এখন ব্যাপারটা যদি একবার মিডিয়ার কানে যায়, আপনাকে জানে মেরে দেবো রাস্তাঘাটে বেরোতে পারবেননা।এসব ক্ষেত্রে আইন মেয়েদের পক্ষে জানেনতো? আর এই মহিলাও ভয়ঙ্কর অ্যারোগেন্ট।তাই যেটা সাজেষ্ট করব, আপনি ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাদাভাবে বসে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিন। আর আমাকে আপাতত পঁচিশ দিন, আপনাকে আজকে অ্যারেষ্ট করছিনা।”
“তুমি কী পাগল?যদি খুন টুন করে দিত?ঐ অন্ধকার বাজে জায়গায়-”
“দিত দিত, সবসময় তো আর বিবেকটাকে ঘুম পাড়িয়ে চোখ বুজে থাকা যায়না? একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আমারও তো একটা দায়দায়িত্ব আছে।
সৌভিকের অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেসে লাইফটা বড্ড ডাল হয়ে গেছিল। একটা অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে তার। এও একটা অ্যাচিভমেন্ট, ওঃ! এতক্ষন যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। সে ঘরের আলো নিভিয়ে খুব হালকা স্বরে রবিশঙ্কর, আলি আকবরের যুগলবন্দীর সিডিটা চালিয়ে দিল, মনটাকে এখন শান্ত করা দরকার।
“হ্যালো, মিষ্টার সৌভিক ব্যানার্জি?”
“বলছি-”
“ওসি, ব্যারাকপুর পি.এস. আপনি বাড়িতে থাকুন, আমরা যাচ্ছি।”
“ছিঃ সৌভিকদা ছিঃ, তোমাকে এত বিশ্বাস করি, এত অন্যরকম মানুষ বলে ভাবি, আর তুমি শেষপর্যন্ত একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে! ছিঃ, এখন আবার আমাকে বলছ মেয়েটাকে ম্যানেজ করতে?'”
“তুই বিশ্বাস কর্ সোমা, তুই নেমে যাওয়ার পর মেয়েটা এমনভাবে আমাকে প্রোভোক করতে শুরু করল, এমনভাবে আমাকে সিডিউস করতে লাগল, খানিকটা ড্রিঙ্ক তো করেইছিলাম বাট, আই ডিডনট রেপ হারাবিলিভ মি, তুই তো এতদিন ধরে দেখছিস আমাকে।ও যে এভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেল করবে! তুই মেয়েটাকে ডাক, টাকাটাই যখন চায়, যত টাকা লাগে-‘”
শেষ পর্যন্ত বিপদের কালো মেঘ সরে গিয়ে সৌভিকের ভাগ্যাকাশে রোদের আভাস দেখা দিল। মেয়েটিকে দিতে হল কড়কড়ে দেড় লাখ, পুলিশ অফিসার কে এক লাখ, সোমাকে পনেরো দিন বম্বে, গোয়া বেড়াতে যাওয়ার অন্যায় সুযোগ।
শেষ পর্যন্ত বিপদের কালো মেঘ সরে গিয়ে সৌভিকের ভাগ্যাকাশে রোদের আভাস দেখা দিল। মেয়েটিকে দিতে হল কড়কড়ে দেড় লাখ, পুলিশ অফিসার কে এক লাখ, সোমাকে পনেরো দিন বম্বে, গোয়া বেড়াতে যাওয়ার অন্যায় সুযোগ। মেয়েটি অন্য একটি কোম্পানিতে জয়েন করে গেছে।
সমস্ত ব্যাপারটাই হ্যান্ডেল করেছে সোমা আর সেই ধুরন্ধর অফিসার।
আকাশ আলো করে মস্ত এক চাঁদ উঠেছে। একদিকে দেখা যাচ্ছে কালপুরুষ কে, তারই পাশে জ্বলছে ধ্রুবতারা। কাকলি এক অদ্ভুত ঔদাসীন্যে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। টিভিতে ‘ছোেটাভীম’ দেখছে তাতান। সৌভিক স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখতেই কাকলি এক ঝটকায় সৌভিক কে সরিয়ে দিল, “ডোন্ট টাচ মি, প্লিজ ডোন্ট টাচ মিঃইউ হ্যাভ লস্ট এভরিথিং। আই ওয়ান্ট সেপারেশন।”
”প্লিজ লিসন্ টু মি, ডোন্ট টেক এ ডিসিশন।এত স্ট্রেস, এত টেনশন, এত প্রেশার, এত কমিটমেন্ট, এত ইনসিকিওরিটি, অল দ্য থিংস মেড মাইসেল্ফ।