“গরীব” এই শব্দটির ব্যবহারিক মূল্য বা বাজারি মূল্য যদি ১০০ টাকা হয় তবে এর ব্যক্তিগত মূল্য হলো ০ (শূন্য)। গরীবের আবার বাজারি মূল্য কি ? আছে আছে। গরীবের বাজারি মূল্য আছে। চোখে দেখা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না। এই যেমন ধরুন “গরীব” শব্দটিকে ব্যবহার করে আপনি মহান সাজতে পারেন। “গরীব” কে দান করে এবং তা সকলকে জানিয়ে আপনি মহাত্মা সাজতে পারেন। “গরীব” কে নিয়ে কথা বলে আপনি সেন্সিবল সাজতে পারেন। “গরীব” এর দাবি কে জনসমক্ষে তুলে ধরে আপনি বিপ্লবী সাজতে পারেন। “গরীব” কেনো গরীব হলো, এই প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক করে আপনি নিখরচায় বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হতে পারেন। “গরীব” কে নিয়ে দু চার কলম লিখলেই আপনি লেখক অথবা কবি হতে পারেন। “গরীব” কে নিয়ে আলোচনা করে আপনার চ্যানেলের টিআরপি আপনি বাড়িয়ে নিতে পারেন। “গরীব” শব্দটির সঠিক প্রয়োগ জানা থাকলে আপনি সরকার গড়তে পারেন আবার সরকার কে গদিচ্যুত ও করতে পারেন। হম “গরীব” শব্দটির এত টাই ক্ষমতা।
এবার আসি “গরীব” শব্দটির ব্যক্তিগত মূল্যে। নেই কিস্যু নেই। কোনো মূল্য নেই। এই যেমন ধরুন “গরীব” শব্দটি আপনি কিছুতেই নিজের নামের পাশে বসাতে চাইবেন না। এবার ধরুন দুর্ভাগ্য ক্রমে শব্দ টা আপনার কপালের সাথে জুড়ে গেলো, মুহূর্তের মধ্যে দেখবেন আপনার চারপাশের পৃথিবী টাই পাল্টে গেছে। আপনাকে সকলে এড়িয়ে চলতে শুরু করবে। কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি কামনা করা হবে না। আত্মীয় স্বজন সম্পর্ক ত্যাগ করবে। বন্ধু মহলে খুব একটা সম্মান আপনার থাকবে না। আপনি ফোন করলে ভয়ে আপনার ফোন কেউ ধরবে না, পাছে আপনি সাহায্য চান। বিশিষ্ট গণের সমাগম যে খানে সেখানে আপনাকে কেউ বন্ধু বা আত্মীয় বলে খাতির করবে না। কেউ কোনো শুভ কাজে বেরোচ্ছে আর আপনাকে দেখে নিল , ব্যাস তার মুখে আপনি আপনার জন্য একরাশ বিরক্তি দেখতে পাবেন। আপনাকে প্রতিনিয়ত রাশি রাশি জ্ঞান শুনতে হবে। আপনি দিন রাত এক করে পরিশ্রম করলেও আপনাকে শুনতে হবে আপনি “ব্যাসিক্যালি কুঁড়ে”। আর এর মধ্যে যদি ভুল করেও আপনার কোনো হিডেন ট্যালেন্ট থাকে ,আর সেটা যদি একবার প্রকাশ পেতে শুরু করে,তখন দেখবেন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠা কাকে বলে। আপনি যত চাইবেন আপনার প্রতিভা দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে তত আপনাকে পিছনে টেনে ধরা হবে। আপনাকে অপমানে অসম্মান এ দুমড়ে মচড়ে শেষ করে দেবে। যতক্ষণ না আপনার আত্মবিশ্বাস আপনি হারিয়ে ফেলবেন ততক্ষণ এই প্রক্রিয়া আপনার সাথে চলতেই থাকবে।
আপনি চোখের সামনে দেখতে পাবেন, যে মানুষ গুলো আপনি “গরীব” বলে আপনার সাথে এরকম আচরণ করে এসেছেন এবং করছেন সেই মানুষ গুলোই আপনার একান্ত আপন ওই শব্দ টা , আরে বাবা ওই “গরীব” শব্দ টা , ওটাকে ব্যবহার করেই মহান, মহাত্মা, সেনসিবল, বিপ্লবী, লেখক কবি, বুদ্ধিজীবী, নিউজ চ্যানেল এর অ্যাঙ্কর অথবা সরকার বিরোধী এবং অবশেষে সরকার সাজার চেষ্টা করছে। আপনি চিৎকার করবেন, বলবেন যে ওটা আমার শব্দ। ওই শব্দের উপর অধিকার শুধু আমার। এত দিন তুমি ওই শব্দ কে অপমান করেছ, অসম্মান করেছ, দিন রাত রক্তাক্ত করেছ আমার ওই শব্দ টিকে, ওকে তুমি আমাকে ফেরত দাও। আপনি চিৎকার করতে থাকবেন কিন্তু আপনার চিৎকার কেউ শুনবে না। কারণ আপনার ওই একান্ত আপন “গরীব” শব্দ টা আজ আর ব্যক্তিগত নেই এখন তা বাজারি হয়ে গেছে। আজ ওই শব্দের মূল্য অনেক। আপনি চাইলেও আর তাকে ফেরত পাবেন না।
** ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি না। ১৩ বছর বয়স থেকে ২২ বছর বয়স পর্যন্ত এই “গরীব” শব্দ টা আমারও একান্ত আপন ছিল। প্রধানমন্ত্রী জির মত আমারও আপনাদের ডাকাতি দেখে মাইকের সামনে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে ” গরিবি মাইনে দেখি হ্যায়”। আপনাদের মহান মহাত্মা বিপ্লবী লেখক কবি বুদ্ধিজীবী মুখোশ গুলো সকলের সামনে টেনে খুলে দিতে ইচ্ছা করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে দেখো এরা এক একটা ডাকাত। আমার থেকে আমার শব্দ কে এরা জোর করে ডাকাতি করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। ভরা বাজারে আমার একান্ত আপন এই শব্দ টিকে এরা নিলামে বসিয়েছে। আমি ওদের শিরায় শিরায় চিনি। তোমরা ওদের বিশ্বাস করো না।………
কিন্তু আমি শান্ত হই। বিশ্বাস রাখি নিজের উপর বিশ্বাস রাখি ঈশ্বরের উপর। আর মনে মনে ওই ডাকাত গুলোর উদ্দেশ্যে বলি “নে ভাই নে, খুশি থাক। কিছু দিতে পেরেছি তোদের। আমার যে শব্দ টা এতকাল তোদের কাছে মূল্যহীন ছিল আজ সেই শব্দ টাই তোদের কাছে আমায় বড়োলোক করে দিল। এই বা কম কি। খুশি থাক তোরা। আর ঈশ্বর তাদের চৈতন্য জাগিয়ে তুলুক যাদের চৈতন্য ঘুমিয়ে আছে।”
লেখিকা – সায়নী দাশগুপ্ত