মহালয়া শব্দটি শ্রবণের সাথে সাথে বাঙালীর হৃদয়ে দুইটি ঘটনা ভেসে ওঠে – প্রথমটি হল এই দিন ভোররাতে আকাশবাণী থেকে সম্প্রচার হওয়া “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠান ও শ্রদ্ধেয় বিরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ। দ্বিতীয়টি হল গঙ্গায় গিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ। প্রকৃতপক্ষে মহালয়া শব্দটির সাথে দেবী দুর্গার কোনও সম্পর্ক নেই; এবং একে “শুভ মহালয়া” বলা উচিত কিনা, অর্থাৎ এটি আদৌ শুভ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
আসলে খুব কম সংখ্যক বাঙালী হিন্দু যেহেতু হিন্দু শাস্ত্রগুলি পাঠ করেন বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলির বিষয়ে চর্চা করেন সেহেতু ঐ কিয়ৎ সংখ্যক বাঙালী হিন্দুই “মহালয়া” সংক্রান্ত সঠিক তথ্যটি সম্পর্কে অবগত। বাকীরা জানেন না বলেই এই দিন দেবী দুর্গার ছবির সাথে শুভ মহালয়া লিখে সকলকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান দেবীপক্ষের। একথা সঠিক যে এই দিন পিতৃপক্ষের শেষদিন ও দেবীপক্ষের সূচণার দিন। সেই হিসেবে “শুভ দেবীপক্ষের শুভেচ্ছা” – এমন বার্তা পাঠানো যেতেই পারে। কিন্তু দেবী দুর্গার ছবির সাথে “শুভ মহালয়া” লিখে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর যে রীতি চলে আসছে তা আসলে ভ্রান্ত। আসলে আকাশবাণী থেকে দীর্ঘদিন ধরে এই মহালয়ার দিন সম্প্রচার হওয়া মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের জন্যও বাঙালী কিছুটা অভ্যাসগত ভাবে “দেবী দূর্গা” ও “মহালয়া” শব্দ দুটিকে একত্র করে ফেলেছে। আমি তো আবার কলেজে পড়ার সময় পর্যন্তও একথা বলতাম যে “কাল রেডিওতে মহালয়া শুনবো”। কিন্তু ঐ অনুষ্ঠানের নাম – মহিষাসুরমর্দিনী। এর সাথে “মহালয়া” শব্দটির কোনও যোগ নেই।
মহালয়া কথাটি এসেছে মহা আলয় থেকে। হিন্দুশাস্ত্র মতে বিশ্বাস করা হয় এই দিন আমাদের পিতৃপুরুষের আত্মার আবির্ভাব ঘটে মর্ত্যলোকে। সকল আত্মার সমাগম ঘটে বলেই একে মহা আলয় বলা হয়। উত্তরপুরুষের নিকট হতে পিন্ড লাভের আশায় পূর্ব পুরুষের আত্মার সমাগম ঘটে। হিন্দুশাস্ত্র মতে, স্বর্গ ও মর্ত্যলোকের মধ্যিখানে অবস্থিত পিতৃলোক। যার শাসক দেবতা হলেন যম। মৃতব্যক্তির আত্মাকে তিনি পিতৃলোকে নিয়ে আসেন। পিতৃলোকে তিন পুরুষ অবস্থান করতে পারেন। অর্থাৎ, আমার পিতা, পিতামহ এবং প্রপিতামহ। বর্তমান উত্তর পুরুষদের মৃত্যুর পর প্রপিতামহ অর্থাৎ ঠাকুর্দার পিতা যমরাজের কাছ থেকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি পাবেন। কিন্তু সেই জন্য বর্তমান উত্তর পুরুষকে তার সমগ্র জীবদ্দশায় পিতৃপক্ষের দিন গুলিতে বা মৃত পূর্ব পুরুষের মৃত্যু তিথিতে পিন্ড দান করে যেতে হবে। তবেই তার প্রপিতামহ তার মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভ করতে পারবেন এবং পরমপুরুষ ঈশ্বরের সহিত একাত্ম হতে পারবেন। যারা মৃত্যু তিথিতে বা সমগ্র পিতৃপক্ষ ধরে পিন্ড দান করতে অক্ষম তারা পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে কোন পুকুর বা গঙ্গায় গিয়ে পিন্ড দান করতে পারেন। কারণ ঐদিন যমরাজ সকল বিদেহী আত্মাকে মর্ত্যলোকে পিন্ড গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। বহু আত্মার সমাগম হয় ঐদিন মর্ত্যলোকে। তাই এই দিনটিকে বলা হয় মহালয়া। চাল,কলা ও অন্যান্য উপাচার সহযোগে পিন্ড দানের মাধ্যমে বর্তমান উত্তর পুরুষ তার পূর্ব পুরুষকে তৃপ্ত করেন। তাই একে তর্পণ বলা হয়। সদ্দিচ্ছা ও নিষ্ঠার সাথে পিন্ডদান করে পিতৃপুরুষ কে তুষ্ট করলে তাঁরা ব্যক্তিকে ধন ও মানের আশির্বাদ করেন।
গনেশ উৎসবের পরবর্তী ভাদ্র পূর্ণীমা তিথিতে সূচণা হয় পিতৃপক্ষের। ঐদিন থেকে পরপর ১৬ টি চান্দ্র দিবস পার করে ভাদ্রমাসের শেষ অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে ও দেবীপক্ষের সূচণা হয়। শাস্ত্র মতে এই ১৬ দিন ধরেই আমরা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করতে পারি। তবে যেহেতু মহালয়াতে তাঁদের মর্ত্যলোকে আগমন ঘটে সেহেতু এইদিন টি বিশেষ ভাবে পূন্যের দিন। বহু পরিবারে এইদিন পিন্ডদান করে ফিরে এসে চন্ডীপাঠ, বেদ পাঠ, ভগবতপুরাণ বা গীতা পাঠ করার চল আছে। এবার যেহেতু এই পিন্ডদান এক অর্থে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সেহেতু এর সাথে “শুভ” শব্দটি যোগ করা হয়ত উচিত নয়। কিন্তু আমার মতে, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে পিতৃপুরুষ যেহেতু স্বর্গ লাভ করবেন সেহেতু এই দিনটি অত্যন্ত পূণ্যের দিন। যা পূণ্যের তা নিশ্চয়ই শুভ। যাইহোক, এবিষয়ে তর্ক থাকবেই। এইদিন যেহেতু সকল আত্মার সমাগম ঘটে সেহেতু সকল আত্মার উদ্দেশ্যেই তর্পণ করা যায়। যাঁদের কোন বংশধর নেই তর্পণ করার জন্য তাঁদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে। এছাড়াও দেব, ঋষি,দিব্যপুরুষ, রাম, লক্ষ্মণের উদ্দেশ্যেও তর্পণ করার নিয়ম আছে।
কিন্তু এই তর্পণ বা পিতৃপক্ষের সূচণা হলো কিভাবে? মহাভারত থেকে জানা যায় দাতা কর্ণ যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করেন তখন তিনি তাঁর নিজ কর্মের পূণ্যের ফলে স্বর্গলোক লাভ করেন। সেখানে তাকে স্বর্ণ খাদ্য হিসেবে দেওয়া হলে তিনি অবাক হয়ে যান। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাকে বলেন, সে যেহেতু সারাজীবন স্বর্ণ দান করে গেছেন সেহেতু স্বর্গে এটিই তার খাদ্য হয়েছে। তিনি কোনদিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কিছু দান করেন নি। যদি তিনি পিতৃপুরুষকে চাল, ডাল ও অন্যান্য উপাচার সহযোগে পিন্ডদান করতেন তাহলে খাদ্য হিসেবে তিনি তাই পেতেন। এমন কথা শুনে কর্ণ বলেন তিনি মৃত্যুর একদিন আগে পিতৃপুরুষের পরিচয় পেয়েছেন তাই তার পক্ষে পিন্ডদান করা সম্ভব ছিল না। ইন্দ্র কর্ণের কথা শুনে তাকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যলোকে প্রেরণ করেন যাতে কর্ণ তার পিতৃপুরুষকে পিন্ডদান করতে পারেন। এই ১৬ দিনকেই পিতৃপক্ষ হিসেবে ধরা হয়।
তাহলে বাঙালীর দূর্গা পুজোর সাথে মহালয়ার কোনই সম্পর্ক নেই? আমার মতে একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক অবশ্যই আছে। দূর্গা পুজোর আসল সময় হল বসন্তকাল। আশ্বিন মাসে সকল দেবদেবী ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময় কোনো পূজাই করা যায় না। কিন্তু ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র ব্রহ্মার পরামর্শে শিবভক্ত রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে দেবী দূর্গার আশির্বাদ লাভের জন্য আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দূর্গা পূজা করেন। যেহেতু এই সময় কোনো পূজা করা যায় না, তাই শ্রীরামের এই পূজাকে বলা হয় “অকাল বোধন” অর্থাৎ অকালে পূজা। এই পূজা শুরু করার পূর্বে শ্রীরাম তাঁর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে মহালয়ার দিনই তর্পণ করেন। কারণ হিন্দু শাস্ত্র মতে, যে কোনো শুভ কাজ আরম্ভের পূর্বে পিতৃপুরুষকে তুষ্ট করে তাদের আশির্বাদ গ্রহণ করতে হয়। শ্রীরাম ও তাই করেন। এইদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে, মহালয়ার তর্পণের সাথে বাঙালীর দূর্গা পূজার সূক্ষ্ম একটি সম্পর্ক পাওয়া যায়। তবুও একথা বলতেই হয় যে, আপনি নিশ্চয়ই কাউকে “শুভ শ্রাদ্ধ” বলবেন না! তাই দেবীর অকালে আগমনের শুভেচ্ছা বার্তা জানাতে হলে “শুভ দেবীপক্ষের শুভেচ্ছা” বলা যেতেই পারে। আদতে “মহালয়া” শব্দের সাথে মা দূর্গার কোনো সম্পর্ক নেই।
লেখিকা: সায়নী দাশগুপ্ত