পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে সামাজিক স্তর বিভাগ (Social Stratification) নেই। এর কারণ হল, কাজের বিভিন্নতা। একটি সমাজ পরিচালনা করতে হলে সেখানে বহু রকমের কাজ আসবেই। মুচি ও জমাদার থেকে শুরু করে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক প্রত্যেকেই সমাজের জন্য অপরিহার্য। আপনি কোন একজনকে ব্রাত্য রেখে সমাজ পরিচালনা করতে পারবেন না। এই স্তর বিভাগের সাথে যুক্ত থাকে সামাজিক মর্যাদা। একেও আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। একজন জমাদার সমাজে যে মর্যাদা ভোগ করেন তার অনেক গুন বেশি মর্যাদা ভোগ করেন একজন সাধু/সন্ন্যাসী। সামাজিক মর্যাদার উন্নতি ঘটাতে মানুষ সবসময় তৎপর থাকেন। কারখানার শ্রমিক চান তার সন্তান লেখাপড়া করে মস্ত অফিসার তৈরি হোক। এর ফলে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ডাক্তারের সন্তান লেখাপড়ায় সুবিধা করতে না পেরে ব্যবসা শুরু করেন। এতেও সামাজিক মর্যাদার হেরফের হয়। আসলে সমাজে যেন একখানা মই রাখা আছে। কখনো কেউ মই বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন আবার কেউ মই বেয়ে নিচে নেমে আসছেন। আমেরিকান সোসিওলোজিস্ট Pitirim Sorokin বললেন এটিই হল Social Mobility বা সামাজিক সচলতা। যেহেতু প্রত্যেক সমাজেই স্তরবিভাগ আছে এবং তার সাথে যুক্ত আছে সামাজিক মর্যাদা তাই প্রত্যেক সমাজেই এইরকম মই আছে। যে মই বেয়ে সমাজের সদস্যদের ওঠানামা লেগেই থাকে। Pitirim Sorokin বললেন, এতেই সমাজ সচল (mobile) থাকে। উনি আরও বললেন, পৃথিবীর কোনও সমাজই সম্পূর্ণ ভাবে Open অথবা সম্পূর্ণ ভাবে Closed নয়। অর্থাৎ, প্রতি সমাজের মধ্যেই এই সামাজিক সচলতা (Social Mobility) আপনি দেখতে পাবেন। এমনকি আপনার গৃহের পরিবেশেও আপনি এই Mobility লক্ষ্য করবেন।
এবার আসি শ্রীমদ্ভাগবতগীতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। আমি ভাগবতগীতার একজন পাঠক মাত্র। ভাগবতগীতাকে ব্যাখ্যা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। একজন সামান্য মুগ্ধ পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজ এই আলোচনা আপনাদের সাথে করছি।
আমরা সকলেই জানি যে, সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মা র মাথা থেকে সৃষ্টি হল ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মা র হাত থেকে সৃষ্টি হল ক্ষত্রিয়, পেট থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে সৃষ্টি হল শূদ্র। পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি এমন টা বলা হয়েছে বলে, বহু মানুষ বলেছেন এর দ্বারা শূদ্র দের অপমান করা হয়েছে। কিন্তু আমি এর মধ্যে কোনও অপমান খুঁজে পাইনি। আপনি যদি আস্তিক হন তাহলে আপনার কাছে ঈশ্বরের মাথা ও পায়ের মধ্যে কোনও ভেদ থাকতে পারেনা। আপনি আপনার নিজের মাথা নিয়ে গিয়ে ঈশ্বরের পায়ের কাছেই সমর্পণ করেন। মনে মনেই হোক কিংবা মূর্তির সামনেই হোক। আমরা মুখেও একথাই বলি যে – ঈশ্বর তোমার চরণে অর্পণ করলাম। কখনো একথা বলিনা যে – ঈশ্বর তোমার মস্তকে অর্পণ করলাম। তাহলে কি ভাবে ঈশ্বরের চরণ থেকে শূদ্রের সৃষ্টি হয়েছে বলেছেন বলে আপনি বলছেন গীতা শূদ্র কে অপমান করছে! আর যদি আপনি একজন নাস্তিক হন তাহলে বলি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে আপনি স্বীকার করেন না কিন্তু নিজের পদযুগলের অস্তিত্বকে তো স্বীকার করেন! একথা তো অনস্বীকার্য যে, পা ছাড়া আমরা চলাফেরা করতে পারবোনা। সমাজে শূদ্র রা সেই পায়ের ভূমিকাই পালন করেন এবং সমাজকে সচল রাখেন। ভাগবতগীতা মানুষের কাজের সূত্র ধরে সামাজিক স্তরবিন্যাস এর কথা বলেছিলেন। সেই অনুযায়ী শূদ্রের কাজ হল সমাজের সেবা বা সমাজ সেবা মূলক কাজ। আমর মতে – ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, জমাদার, মুচি, ম্যাথর এই ধরনের সব সব পেশা গুলি শূদ্রের পেশা। কারণ এগুলো সমাজ সেবা মূলক কাজ। আর এদের ছাড়া সমাজ চলবে না। কারণ এরা সমাজের “পা”। মানে আমরা সবাই সবাই যারা চাকুরী জীবী ও সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত সবাই শূদ্র। আমরা নিয়ত আমাদের কাজের দ্বারা সমাজের সেবা করে চলেছি। আমাদের ছাড়া এই সমাজ অচল। যদিও ডাক্তার ও শিক্ষকদের পেশা মাথার ই কাজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণের কাজ। তবু তাদের মধ্যে যদি ব্রাহ্মণের নয়টি গুন না থাকে (যা গীতায় বর্ণিত) তাহলে তিনি ঐ সেবা টুকুই করছেন।
এবার আসি বৈশ্যের কথায়। গীতা বলছেন, ব্রহ্মা র পেট থেকে সৃষ্টি হল বৈশ্য। এদের কাজ হল সমাজের সকলের পেট চালানো। অর্থাৎ সমাজের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া। কৃষক ও ব্যবসায়ী রাই হলেন বৈশ্য। এনারাই সমাজের মুখে অন্ন তুলে দেন।
ব্রহ্মা র হাত থেকে সৃষ্টি হল ক্ষত্রিয়। এদের কাজ হল নিজের শক্তিশালী হাত দিয়ে সমাজকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করা। ক্ষত+রীয়। অর্থাৎ ক্ষত থেকে রক্ষা করেন যিনি। প্রাচীন যুগে রাজা বা সম্রাট রা এই কাজ করতেন তাই তাদের তখন ক্ষত্রিয় বলা হত। এখন এই দায়িত্ব পালন করছেন দেশের সেনাবাহিনী। আর্মি, পুলিশ এরাই হলেন বর্তমানে ক্ষত্রিয়।
আর ব্রাহ্মণ হলেন সেইসব মানুষ যারা সংসারের সব মোহমায়া ত্যাগ করে ব্রহ্ম সাধনায় মগ্ন। এদের মধ্যে যারা অতিব পন্ডিত ব্যক্তি তারা সমাজকে জ্ঞান দান করেন। সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান। এদের মধ্যে কোনো রকম পার্থিব সুখ ভোগের বাসনা থাকে না। শিশুর মত পবিত্র ও জ্ঞানের আলোয় বলীয়ান ব্যক্তি ই হলেন ব্রাহ্মণ। গীতা য় ব্রাহ্মণের নয় টি গুণের কথা বলা হয়েছে। যা পাঠ করলেই ব্রাহ্মণ কে এবং কেন এর একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। আমার কাছে ব্রাহ্মণ হলেন – শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ।
ভাগবতগীতা বলছেন, যার যেমন কাজ তার তেমন বর্ণ। এই কথার মধ্যে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ Social stratification এর কথাই বলেছেন। যা আপনি কোনভাবেই মুছে ফেলতে পারবেন না। যে কমিউনিস্ট রা শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলেন সেই কমিউনিস্ট রাও তাদের পরিচালিত দেশ গুলি থেকে Social stratification মুছে ফেলতে পারেন নি। মহাভারতে যুধিষ্ঠির একসময় বলেছেন – যদি কোনো শূদ্রের মধ্যে ব্রাহ্মণের গুণ দেখা যায় তাহলে তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে যান, আর যদি একজন ব্রাহ্মণের মধ্যে ব্রাহ্মণের নয়টি গুন পরিলক্ষিত না হয় তাহলে তিনি আর ব্রাহ্মণ থাকেন না। ভাগবতগীতাও এই পরিবর্তনের সপক্ষের কথা বলেছেন। আর এই পরিবর্তনই হল – পশ্চিমের দেশ গুলির বহুল ব্যবহৃত শব্দ “Social Mobility”।
আমরা প্রশ্নহীন ভাবে পশ্চিমের সব আবিস্কার, সব দর্শন সরল ভাবে গ্রহণ করে নিই। কিন্তু নিজের দেশের দর্শন গুলিতে যে ঐ সকল কথা গুলিই বহু আগেই আলোচনা করা হয়ে গেছে তা আমরা জানার চেষ্টা ও করি না। নিজের দেশের মূল্যবান সম্পদ গুলি কে আমরা অবিজ্ঞান বলে দূরে ঠেলে দিই। কিন্তু অবিজ্ঞান কেও যে অবিজ্ঞান প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞান সম্মত ভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং পড়তে ও জানতে হবে সেই বিষয়ে আমরা নীরব থাকি। আর এই নীরবতা, অন্যের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া এগুলো কখনও বিজ্ঞান হতে পারে না। ওগুলো অবিজ্ঞানের গোত্রের পড়ে।
বি.দ্র – সম্পূর্ণ নিজস্ব মত। ভুল মনে হলে জানাবেন। ভিন্ন মত হলে জানাবেন।
লেখা – সায়নী দাশগুপ্ত