পুকুর ঘাটের সাথে মানুষের মনকে তুলনা করে স্বামীজী বললেন, ঘাটের সিঁড়িতে যে জায়গায় বারবার ঢেউ আছড়ে পড়ে সেই স্থানে ঢেউয়ের ছাপ থেকে যায়। মানুষের মনও ঠিক তেমনি। পুকুর ঘাটের ঐ সিঁড়িটির মতন। মানুষ সারা দিবস যা শোনে, যা ভাবে, যা বলে, যা করে সবকিছুর ছাপ তার মনের উপর পড়তে থাকে। আমাদের সারাদিনের প্রত্যেকটি চিন্তা, কর্ম এক একটি ঢেউয়ের মত। যা আমাদের মনে একটি ছাপ রেখে যায় এবং পুনরায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করে। আমি যদি সারাদিন কু-কথা বলি ও শুনি, কু-কাজ করি তাহলে তার একটি ছাপ আমার মনে পড়বে এবং ঐ একই ধরনের কাজের দিকে আমাকে সে বারবার ঠেলে দেবে। যার ফলে প্রত্যেকবার আমার মনে কু ছাপ পড়বে। ভালো কাজের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরকম। আমার সারাদিনের ভালো কাজগুলো আমার মনে ভালো কাজের ছাপ ফেলবে এবং বারবার ভালো কাজের দিকেই ঠেলে দেবে। ভালো বা খারাপ কাজের (ঢেউয়ের) এই প্রত্যাবর্তন এবং ছাপ ফেলে যাওয়ার বিষয় দুটিকে স্বামীজী একত্রে বললেন – সংস্কার (Notion)। স্বামীজীর মতে, আজ আমি যা তা হলো আমার অতিতের সংস্কার গুলির যোগফল। আর সেটিই হলো আমার বর্তমানের চরিত্র (Character)। আমাদের মনে যে সংস্কার গুলো (বা ঢেউয়ের ছাপ গুলো) মনের উপরের স্তরে থাকে অর্থাৎ চেতন ও অচেতন মনে থাকে সেই সংস্কার গুলির থেকেও বেশি শক্তিশালী হয় যে গুলো আমাদের অবচেতন মনে চলে যায়। অবচেতন মনে থাকা সংস্কার গুলি আমাদের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বামীজী বললেন, প্রকৃত চরিত্র গঠন করতে হলে – ভালো বা মন্দ কোনও প্রকার ছাপ ই মনের উপর পড়তে দেওয়া চলবে না। মনকে করে তুলতে হবে একেবারে সমান ও পরিস্কার। যেখানে কোনো ছাপ নেই। একদম শৈশবের মতো। নদীর বা পুকুরের ঘাট যখন প্রথমবার তৈরি হয় তখন যেমন তাতে কোনো দাগ থাকে না, আমাদের মনকেও ঠিক তেমনই করে গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব। সকলে বলে খারাপ চিন্তার ছাপ মনে ফেলো না। স্বামীজী বললেন, খারাপের সাথে ভালো চিন্তার ছাপও মনে ফেলো না; কারণ দুই প্রকার ছাপ ই বলিষ্ঠ চরিত্র গঠনের পরিপন্থী। এ উপদেশের তাৎপর্য কী? আসলে আমরা যখন কোনো ভালো কাজ করি তখন আমাদের মধ্যে একটি আত্মতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। হয়তো ভালো কাজের জন্য সমাজ আমার খুব প্রশংসা করল, যার ফলে আমার মনে সে বিষয়ে প্রচ্ছন্ন গর্ব তৈরি হল। এই গর্ব, বা আমি ভালো এইরকম ধারণা গুলো হল ভালো কাজের ছাপ। যা আদতে বলিষ্ঠ চরিত্র গঠনের পরিপন্থী। পরবর্তীতে যখন আমি আবার ভালো কাজ করতে যাবো আমার মনে ঐ ছাপ গুলো নড়েচড়ে বসবে। আমার কাজের সাথে জড়িয়ে যাবে আত্মতৃপ্তি ও গর্ব। এর ফলে একটি ভালো কাজ করা সত্ত্বেও আমি বলিষ্ঠ সু চরিত্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হবো। কিন্তু কাজ করলে তার ছাপ তো মনে পড়বেই। ছাপ না ফেলে কিভাবে কাজ করা সম্ভব!! সম্ভব। নিষ্কাম কর্ম করতে থাকলে অতীত ও বর্তমানের কাজের সকল ছাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে।
নিষ্কাম কর্ম হল – ফলের আশা না করে কাজ করা। যা শ্রীমদ্ভাগবত গীতা বলছেন। কিন্তু আমি একটি কাজ করবো অথচ তার ফলের কোনো আশা করবো না – এ কেমন করে সম্ভব। এসব সাধুসন্ত দের পক্ষেই সম্ভব, সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়। ফলের চিন্তা না করে কর্ম করা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব। একবার ভেবে দেখুন আপনি পরীক্ষার জন্য খুব ভালো ভাবে তৈরি হলেন। আশা করলেন যেমন তৈরি হয়েছেন তেমন ফল আসবে। সবসময় আপনার আশা পূরণ হয়েছে কী? ভেবে দেখুন আপনি ভাবলেন আজ রাতে আপনি বাড়ি ফিরে একটি সিনেমা দেখবেন। সবসময় যা ভেবেছেন তা পেয়েছেন কী? হয়ত যা আশা করেছেন পরিস্থিতি সেই অনুকূলই ছিল। সব কিছু ঠিকই ছিল। যেমন সময় যাচ্ছিল মনে করছিলেন যে, যে টা আশা করেছেন সেটাই পাবেন, বা ঘটবে। কিন্তু সবক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে কী? কোনো সময় কী এমন হয়নি যে শেষ মূহুর্তে এসে সব অন্যরকম হয়ে গেছে। আসলে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা বলছেন, আমাদের মানুষদের হাতে কেবল মাত্র আমাদের কর্মের অধিকার টুকুই আছে। ফল আমাদের হাতে নেই। ফল দেবেন ঈশ্বর (আপনি যদি ঈশ্বর না মানেন তাহলে প্রকৃতি, কিংবা কোনো অতিন্দ্রীয় সত্তা, যিনি সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন)। ছাত্রের কর্ম হল পড়াশোনা করা। সে সেটুকুই করুক। ফল ঈশ্বর দেবেন। ফলের আশা না করে যে কাজ আমরা করি তা নিষ্কাম কর্ম হয়ে যায়। আর নিষ্কাম কর্মের কোনো ছাপ আমাদের মনে পড়ে না। স্বামীজী বললেন, প্রথমে খারাপ কাজ করা বন্ধ করে খারাপ কাজের ছাপ দূর করতে হবে। তারপর ভালো কাজ করার সাথে সাথে নিষ্কাম কর্ম করার দিকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর ফলে ভালো কাজের ছাপও মন থেকে মুছে যাবে এবং গড়ে উঠবে বলিষ্ঠ চরিত্র।
লেখিকা: সায়নী দাসগুপ্ত